মায়ের ভাষায় ভাব প্রকাশের অধিকার আদায়ে বুকের তাজা রক্ত দেওয়ার নজির কেবল বাংলাদেশেই আছে। ভাষা হিসেবেও সেই গৌরব বয়ে বেড়াতে পারছে বাংলা। এত ত্যাগ-তিতিক্ষা—তবুও দেশের সর্বত্র বাংলাভাষা এখন পর্যন্ত চালু করা সম্ভব হয়নি।
এই লেখকের তিন বছরের প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা বলছে—মাতৃভাষা ব্যবহারে দক্ষিণ কোরিয়া অন্যদের জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। দেশটির নাগরিকেরা জীবনের প্রতিটি পরতে যেন পরম মমতায় অনুভব করছেন নিজেদের মাতৃভাষাকে।
রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমাদের দৃষ্টির সীমানায় ধরা পড়ে মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি তথা বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি জগৎ।
শুনতে পাই মানুষ ও প্রাকৃতিক বিচিত্র ভাষা। আসলে ভাষা মানুষের অস্তিত্বে যেমন বিরাজমান, তেমনি প্রকৃতির অস্তিত্বেও। তাই তো সবাই নিজের মতো করে কথা বলে নানার ভঙ্গিমায়—ইশারায়। বলা হয়, ভাষা আছে বলেই এতো প্রাণচঞ্চল ও আনন্দময় এই পৃথিবী ।
ভাষা সর্বত্র যোগাযোগের সেতু। মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি, আরবি, কোরিয়ান, জাপানিজ ইত্যাদি ভাষা শিক্ষা এবং পারদর্শিতা হাজারো সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে বাংলাদেশিদের।
দিন দিন বিশ্বের সাথে যোগাযোগের পথ প্রসারিত হচ্ছে। যা জীবন ও জীবিকার কাজে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
এ গ্রহে প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আমাদের প্রবাসীরাই মাতৃভাষার পাশাপাশি কয়েকটি ভাষা পারদর্শী হয়ে উঠেছেন। ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের লোকেরা স্বীকার করতে বাধ্য যে বাঙালি মেধাবী জাতি।
তবে তৃপ্তি নেই সে শব্দচয়নে যদি না থাকে বাংলা। বিদেশের মাটিতে চলার পথে হঠাৎ কোথাও থেকে যদি একটি বাংলা শব্দ ভেসে আসে তখন কলিজাটা অনেক বড় হয়ে যায়। মাতৃভাষার প্রতি প্রবাসীদের আবেগ জড়ানো অন্যরকম একটি টান।
চলছে ভাষার মাস, ২১ ফেব্রুয়ারিতে স্মরণ করবো যাদের রক্তে কেনা আমারা মাতৃভাষা বাংলা পেয়েছি তাদেরকে। বিশ্বজুড়ে একটাই সুর ধ্বনিত হবে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি?’
তার পরের দিন থেকে আমরা ভুলে যাই বাংলা ভাষার কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা ও শুদ্ধ প্রয়োগ। আমি একটু বলতে চাই, মাতৃভাষার ভালোবাসা এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ যদি দেখতে চাই তাহলে দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে তাকাতে হবে। কোরিয়ার জাতীয় ভাষা হ্যাঙ্গুল।
প্রতি বছর ৯ অক্টোবর হ্যাঙ্গুল ডে (কোরিয়ান ভাষার দিন) পালন করা হয়। কোরিয়ার ভাষা তৈরি করেছেন কিং সেজং। কোরিয়ানরা কেবল একটি ভাষাতেই কথা বলেন এবং লিখেন। বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী অনুসারে তারা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে তবে দক্ষিণ কোরিয়ায় সারা দেশে মাত্র একটি ভাষা পাবেন।
পার্থক্যটি হলো স্পিকিং অ্যাকসেন্ট বা ডায়ালেক্ট কিছু আলাদা। কোরিয়ান লোকেরা তাদের ডাকে 사투리 (সাথুরি)। রাজা সেজং নিজে হ্যাঙ্গুয়েলের বিষয়ে বলেছিলেন, ‘একজন জ্ঞানী ব্যক্তি সকাল শেষ হওয়ার আগেই হ্যাঙ্গুলের সাথে পরিচিত হতে পারবে এবং একজন বোকা লোক মাত্র দশ দিনের মধ্যে এই ভাষা এটি শিখতে পারে।’
কোরিয়ানরা এই দিনে সেজং রাজার কথা স্মরণে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এ আয়োজনের মধ্যে তারা সীমাবদ্ধ নয়। তাদের সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, শিল্প-কলকারখানা থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করেন।
ইংরেজির ব্যবহার একদম নেই বললেই চলে। তারা ইংরেজি জানলেও খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার করেন না। আপনি যদি তাদের মোবাইল নম্বর জানতে চান তাও তারা বলবে নিজেদের ভাষাতেই—যা আমরা ইংরেজি ছাড়া বলি না।
সাধারণত আমাদেরকে কেউ ফোন করলে আমরা ফোনটা ধরেই বলি hello ‘হ্যালো’। কোরিয়ানদের কখনো এই শব্দটা ব্যবহার করতে দেখিনি।
ফোনটা ধরেই তাদের ভাষায় 여보세요 (ইয়ভোসেইউ) বলেন। এখানে ডাক্তারের দেয়া প্রেসক্রিপশন বা ওষুধের ব্যবস্থাপত্রটিও কোরিয়ান ভাষায়। আর ঔষধের গায়ের ভাষাটিও তাদের নিজস্ব।
তাদের ভাষার সফটওয়্যার দিয়েই তারা কম্পিউটার ব্যবহার করেন। ভিনদেশি নয়—নিজের ভাষাকে সহজ এবং ছোট করে বলতে কোরিয়ানরা বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এক কথায় মাতৃভাষার ভাষার প্রতি ভালোবাসা তার প্রয়োগের অনন্য দৃষ্টান্ত দক্ষিণ কোরিয়া।
বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ থেকে শুধু কোরিয়ান ভাষাদক্ষ ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের ঠাঁই হয় এদেশে। ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশেষ চুক্তিতে কোরিয়ান ভাষা শিখে ১৩ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশির বসবাস এই কোরিয়াতে।
বিশ্বের যেখানেই বাংলা ভাষাভাষীরা আছেন—সেখানেই আছে আমাদের গৌরবের শহীদ মিনার। তবে স্থায়ী হোক আর অস্থায়ী—বিদেশের মাটিতে বাংলা ভাষা আর বাংলাদেশিদের গৌরবের মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকাটাই সম্মানের।
রাজধানী সিউলের অদূরে আনসান শহরে কোরিয়ার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক স্থায়ী শহীদ মিনার। এই মিনারে বাঙালিসহ অন্যান্য ভিনদেশি ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। প্রতিবছরই কোরিয়ায় প্রবাসীরাসহ বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়।
তবে আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে আরেকটি সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। সেটা হল—বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে এক অদ্ভুত জগাখিচুরি ভাষার তৈরি।
আর ইরেজি উচ্চারণে বাংলা শব্দ উচ্চারণের প্রবণতাও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। টেলিভিশন, এফএম রেডিও থেকে শুরু করে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই অস্বাভাবিক প্রবণতাটি দেখা যায়।
আমাদের দেশে শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে হাতেগোণা কয়েকটির নাম বাংলায়—বাকিগুলো ইংরেজিতে। এই নামগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই যে এগুলো আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে আইন করে বলে দেয়া আছে নেপালি ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় শিক্ষা প্রতষ্ঠানের নাম থাকতে পারবেনা। থাকলে সরকারের অনুমোদন পাবেনা।
পরীক্ষায় যে ছেলে/মেয়েটি ইংরেজিতে ‘এ’ প্লাস পায় সে নাকি বাংলায় ফেল করে। বিনোদন জগতে নজর দিলেও তথৈবচ অবস্থা দেখা যায়। বাংলা চলচ্চিত্রের ইংরেজি নাম। গানের কথাও একই অবস্থা। এটা আমাদের সংস্কৃতির জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি।
অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ডের নামটিও ইংরেজিতেই সমধিক পরিচিত। চলচ্চিত্রে ইংরেজি নাম বাতিল করার পাশাপাশি সেন্সর বোর্ডের নামও পরিবর্তন করে বাংলায় করা উচিত। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে এখন বিদেশের অপসংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে তাই ভাষাগত পরিবর্তনও দেখা দিয়েছে।
তাছাড়াও কিছু মানুষ দেখা যায় বক্তৃতায়, টকশো কিংবা সাক্ষাৎকারে অর্ধেক ইংরেজিতে, অর্ধেক বাংলায় বলে। মনে হয় যেন—তাদের মাতৃভাষাটা ইংরেজি—অনেক কষ্টে বাংলা বলছেন।
বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাধ্যতামূলক বাংলাভাষা ব্যবহারের আইন আছে। সংবিধানেও বলা হয়েছে—রাষ্ট্রের ভাষা হবে বাংলা। অথচ এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা যায়নি।
বিশ্লেষকরা এক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করছেন। সমস্যা পরিভাষার নয়, ইচ্ছাশক্তির। আমাদের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত হওয়া উচিত।
পারিবারিক এবং সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে জোরালো উদ্যোগে আমাদের সেই ১৯৫২-এর আবেগ, দেশপ্রেম, আত্মমর্যাদাবোধ আর শহীদের রক্তে রাঙা ২১ ফেব্রুয়ারির প্রতি সত্যিকারের ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব।
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনই ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রেষ্ঠ উপায়।
লেখক: মোহাম্মদ হানিফ, দক্ষিণ কোরিয়া প্রবাসী সাংবাদিক