আবু তাহের রাশেদ। পড়াশোনা শেষ করে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে নিজেকে বাচাতে বেছে নেন স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ব্যবসা। আত্মপ্রত্যয়ী রাশেদ অল্প সময়ে সফলতাও দেখতে পান নিজের পরিশ্রম আর চেষ্টায়। বিয়ে করে একবছরের মধ্যে কন্যা সন্তানের বাবা হয়ে সুখের সংসারে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। বিধাতার লিখন টিকেনি তার এই স্বপ্নের সংসার। ২০১১ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় পাইনালকট ইনজোরি হয়ে দেশ বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার পর আর দাড়াতে পারেননি। হুইল চেয়ারে তার স্বপ্ন আবদ্ধ হয়ে যায়। আবদ্ধ স্বপ্নকে বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাশেদ তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যেতে থাকেন দৃঢ় প্রত্যয়ে।
যে স্ত্রী বিবাহের এক বছরের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু স্বামী ছেড়ে কখনো যায়নি, সকল দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করে স্বামীর ভালোবাসায় শিক্ত হয়ে পাশে থেকেছেন দশ বছরের অধিক সময় সেই স্ত্রীকেও কেড়ে নিল আরেক সড়ক দুর্ঘটনা। ২০২১ সালের মার্চ মাসে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন তার স্ত্রী লুৎফুন্নাহার শিমা। পঙ্গু রাশেদ স্ত্রী হারিয়ে দশ বছরে মেয়েকে নিয়ে বাকরুদ্ধ। বেঁচে থাকার সান্তনা আর স্বপ্নপূরণে সকল পথ যেন ভুলিয়ে দিয়েছে দুটি সড়ক দুর্ঘটনা।
বলছিলাম ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার রামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইদ্রিস আলীর স্বপ্নবাজ ছেলে আবু তাহেরের রাশেদের জীবনের গল্প। সড়ক দুর্ঘটনায় এভাবেই যেন প্রতিটি পরিবারের দুঃসহ যন্ত্রণা আর কষ্ট বয়ে আনে অসাবধানতা আর অসচেতনতার জন্য।
রবিবার দুপুরে রাশেদের সাথে কথা হচ্ছিল জীবনের জন্য দেখা স্বপ্নগুলো আর স্বপ্নভাঙ্গার করুণ আর্তনাদে হারিয়ে প্রিয় মানুষের জন্য বুকের ভিতরের হাহাকার আর কান্নার কথা কথা।
২০১০ সালে ২৫ বছরের স্বপ্নবাজ তরুণ রাশেদ পড়াশোনা শেষ করে বসে থাকেনি চাকরির জন্য। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া বাবার ব্যবসা দেখাশোনার জন্য নিজেকে নিয়োজিত না করে নিজেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্টিত করতে চেয়েছেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী অল্প পুঁজি নিয়ে শুরু করেন মাছের খামার ও পোল্ট্রি ব্যবসা। বাবা ত্রিশালের প্রতিষ্ঠিত ডিলার হলেও তিনি বেছে নেন অন্য ব্যবসা। ২০১০ সালের ১৬ জুন উপজেলার বালিপাড়া গ্রামের আবুল কালামের মেয়ে লুৎফুন্নাহার শিমার সাথে পারিবারিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শুরু করেন নতুন জীবন। একবছরের মধ্যে তার ঘর আলোকিত করে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান। স্বপ্নের এই কেড়ে নেয় একটি সড়ক দুর্ঘটনা। ২০১১ সালের জুলাই মাসের ৭ তারিখে ব্যবসায়ীক কাজে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে সিএনজি লেগুনা দুইটি গাড়ি নিজেরা অভারট্রেকিংয়ের প্রতিয়োগিতা করায় ধাক্কা দেয় রাশেদের মটর সাইকেলে। ছিটকে পরে রাস্তা পাশে। স্থানীয়রা দ্রæত তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যালে স্থানান্তর করে। প্রায় এক মাস কোমায় থাকার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ নেওয়া হলেও প্রায় পাচ বছর চিকিৎসার পর পাইনালকট ইনজুরি হওয়ায় স্বাভাবিক কথা বলতে পারলেও আর কোনোদিন নিজের দুপায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারেনি। হুইল চেয়ার আর প্রিয়তমা স্ত্রীর কাঁধে ভর করেই স্বপ্নপূরণে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বাচার চেষ্টা করে রাশেদ। স্ত্রী বিয়ের এক বছরের মধ্যে পঙ্গু স্বামীকেও ছেড়ে যাননি একটি মুহূর্তের জন্য। নিজের স্বপ্নগুলো বাদ দিয়ে স্বামীর স্বপ্নপূরণে শিশু সন্তানকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় জীবনযুদ্ধে ঝাপিয়ে পরেন। সেই স্বপ্নটুকুও কেড়ে নিল সেই অভিশপ্ত সড়ক দুর্ঘটনা।
২০২১ সালের ৮ মার্চ বালিপাড়া নিজের বাড়ি থেকে ত্রিশালে আসার জন্য রাস্তা পারাপারের সময় লেগুনা চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই নিহত লুৎফুন্নাহার শিমা। স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদে বাকরুদ্ধ রাশেদ স্ত্রীর লাশ কাঁধে নিতে না পারলেও ৯ বছরের সন্তানকে কোলে নিয়ে জীবনের স্বপ্নটাকেই চিরনিদ্রায় শায়িত করেন। এক ভাই দুবোনের সংসারে একমাত্র ছেলে রাশেদ বৃদ্ধ বাবামাকে দেখাশোনার জন্য প্রিয়তমা স্ত্রীকে পাশে পেয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখলেও স্ত্রী হারিয়ে সেই স্বপ্নটুকু অনিশ্চিয়তায় ডুবে গেছে। পঙ্গু পিতা মা হারানো শিশু সন্তানকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই কারো চোখে মুখে। উত্তর নেই রাশেদের কাছে শুধু একটি কথায় অভিশপ্ত সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ না হলে আমাদের দেশের স্বপ্নগুলোও একদিন পঙ্গু হয়ে পরে থাকবে।