বরিশালের সদর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কার্যক্রমে সাক্ষী প্রদানে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিতকরণে সাক্ষী প্রতি ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা হাতানোর অভিযোগ উঠেছে কতিপয় প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) সুপারিশ ছাড়া যাদের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ‘বেসামরিক গেজেটে’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তাদের সনদ যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ২০০২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪২ হাজার নাম জামুকার সুপারিশ ছাড়া গেজেটভুক্ত হয়েছে। তাই তাদের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে যাচাই বাছাইয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিনজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষী নিতে হবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য। আর এ সুযোগে এই সাক্ষী বিক্রির হিড়িক পড়েছে।
এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত হোসেন চৌধুরী বলেন, মোটা অংকের টাকা বাণিজ্য হইছে মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ে, এটা অস্বীকার করবো না। শুধু সদর উপজেলায় নয়, অধিকাংশ জায়গায়ই এরকম হয়েছে। তবে লাল মুক্তিবার্তায় যে সব মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে তারা যদি মিথ্যা সাক্ষী দেয় তাহলে ওই সাক্ষী দাতার মুক্তিযোদ্ধার ভাতাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এরপরেও কেনো যে এই সাক্ষী বাণিজ্য জড়িয়েছেন বুঝে উঠতে পারছি না। আর আমি এই ধরণের ন্যাক্কারজনক কাজের নিন্দা জানাই।
অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল সদর উপজেলার রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নে ফকির হাটখোলা এলাকার মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিকদার মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সাক্ষী প্রতি মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি সাক্ষী দেয়ার পুরো প্যাকেজ নিয়ে থাকেন। প্যাকেজে নিজে এবং আরও দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে সাক্ষী হিসেবে নেয়া হয় একজনকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য।
তিনি এ প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত একাধিক সাক্ষী বাণিজ্য করেছেন। আর এমন সাক্ষী বাণিজ্যের চালচিত্র তিনি দেশ জনপদ পত্রিকার অনুসন্ধান টিমের কাছে অকপটে স্বীকার করেন।
এ সময় তিনি বলেন, আমি সোলনা এলাকার খাদেম হোসেন আকনের পক্ষেও সাক্ষী দিয়েছি। সে আমাকে টাকা দিয়েছে।
এ সময় তার কাছে দরিদ্র ও অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষীর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের ক্ষেত্রে বেশি নেব না, আমাকে ৫ হাজার টাকা এবং বাকি দুজন সাক্ষীকে ৫ হাজার করে দিলেই হবে। একদম বিনা পয়সায় তো সাক্ষী দেয়া যায় না। এর জন্য কেউ কেউ আবার ৫০ হাজার টাকাও নেয়। আবার কোনো কোনো জায়গায় সাক্ষীর জন্য লাখ টাকাও লেনদেন হয়েছে। সেই হিসেবে আমি তো কমই চাইছি।
এদিকে তার এহেন কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বরিশাল সদর উপজেলার ইউনিয়ন কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা সুলতান শরিফ বলেন, আমিও শুনেছি ২/১ জায়গায় এরকম হয়েছে। আর কে কতো নিয়েছে আমি জানি না। আর আমি কোথাও সাক্ষীও দেয়নি। আমার ইউনিয়ন থেকে যাচাইতে ছিলো ১২ জন।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে এ ধরনের সাক্ষী বাণিজ্য আপনি কিভাবে দেখছেন জানতে চাইলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এটা একটি জালিয়াতি। এ ধরণের কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
এ সময় তিনি আরও বলেন, যাদের লাল বই (মুক্তিবার্তায়) নাম আছে এইরকম তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে সাক্ষী হতে হবে মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে। আর যাচাই-বাছাই করতে উপজেলা পর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, কমিটির সভাপতি হবেন সংশ্লিষ্ট উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার বা লাল মুক্তিবার্তায় নাম থাকা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যাকে জামুকার চেয়ারম্যান মনোনীত করবেন। কমিটির সদস্য হবেন সংশ্লিষ্ট উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার বা লাল মুক্তিবার্তায় অন্তর্ভুক্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যাকে স্থানীয় এমপি মনোনীত করবেন। আরেকজন সদস্য হবেন সংশ্লিষ্ট উপজেলায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার বা লাল মুক্তিবার্তায় অন্তর্ভুক্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যাকে জেলা প্রশাসক মনোনীত করবেন। কমিটির সদস্যসচিব হবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ আমার দপ্তরে নেই। তবে অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গৃহীত হবে। আইন রয়েছে কেউ যদি মিথ্যা সাক্ষী দেয় তার ৬ মাসের কারাদণ্ড হতে পারে।
মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে সাক্ষী বাণিজ্য রুখে দেয়ার ব্যাপারে বরিশাল জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, আমি এখনই ইউএনওকে বলে দিচ্ছি বিষয়টিতে যাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হয়।