কোটি টাকার ঝুট, মাদক সাম্রাজ্য, স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় নিয়োগ, পদ বাণিজ্য, দখলদারি, ঠিকাদারি—সব কিছুতেই জড়িয়ে তাঁর নাম। বিচার-সালিস থেকে শুরু করে ডিশ, ইন্টারনেট, ফুটপাত, ট্রাকস্ট্যান্ড, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশায় চাঁদাবাজিসহ যেখানেই টাকার গন্ধ সেখানেই মতি চাচা। অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যবসার কথা বলে এবং সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর বানানোর আশ্বাস দিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও। অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাং ও ক্যাডার বাহিনী পালনের।
এত সব অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে তিনি হলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী গাজীপুর-২ আসনের সাবেক এমপি মো. জাহিদ আহসান রাসেলের চাচা মতিউর রহমান মতি। ভাতিজা এমপি হলেও তাঁর আঙুলের ইশারায় চলত টঙ্গী-গাজীপুর। চাচার ভালো-মন্দ সব কাজে ছিল ভাতিজা রাসেলের অকুণ্ঠ সমর্থন। আর ভাতিজার আশকারায়ই ‘মতি চাচা’ হয়ে ওঠেন দেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিল্পনগরীর সত্যিকারের ‘ডন’।
মতির রাজত্বে কিছুটা ধস নামে ২০১৮ সালের পর। সেবারের নির্বাচনে জেতার পর যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ভাতিজা রাসেল। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর কয়েকজন নেতা রাসেলের স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বলয় তৈরি করেন। এতে মতির ঝুট ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ কয়েকটি বড় খাতের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যায়।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মতি নিজ বাহিনী দিয়ে কবজায় নেন টঙ্গী শিল্পনগরী ও টঙ্গী বিসিক, বোর্ডবাজার এবং পুবাইল শিল্পঞ্চলের শতকোটি ঝুট ব্যবসা। নিয়ন্ত্রণ নেন টঙ্গীর অপরাধজগৎ থেকে মাদক সাম্রাজ্য, এমনকি ফুটপাতও। দলীয় পদ বাণিজ্য, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগেও ছিল তাঁর অফুরান প্রভাব। ঝুট খাত থেকে পেতেন প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। এদিকে টঙ্গীর ১৯ বস্তিতে মাসে লেনদেন হয় শতকোটি টাকা। এই ব্যবসার একটি অংশ আসত মতির তহবিলে।
২০২২ সালে মতির হুমকিতে বায়না দলিলে ১০০ কোটি টাকার জমি ৬০ কোটি টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হন স্থানীয় লিটু মিয়া। এভাবে অনেকের জমি ও সম্পদ হাতিয়ে নেন মতি চাচা। গাজীপুর মহানগর, টঙ্গী থানা, বিভিন্ন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ কমিটি ছিল তাঁর মুঠোয়। সম্পদ ও ব্যবসার লোভ দেখিয়ে অনেকের টাকাও তিনি মেরে দিয়েছেন। মতি দেশব্যাপী সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন গত বছর হক গ্রুপ অব কম্পানির এমডি আদম তমিজী হকের কারখানায় দলবল নিয়ে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাসেল যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হন। তারপর টঙ্গীতে টেলিফোন শিল্প সংস্থার মাঠে বাবার নামে একটি মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ শুরু করেন, যা এখনো শেষ হয়নি। গাজীপুরে বাবার নামে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করেন। পাঁচবার এমপি হওয়ার পরও তাঁর দৃশ্যমান উন্নয়ন এ পর্যন্তই।
তবে সরকারি টাকায় নির্মিত কমপক্ষে ২০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবনের নামকরণ রাসেল করেছেন প্রয়াত বাবা ও নিজের নামে। আর আওয়ামী লীগ ছাড়া সব সহযোগী সংগঠনের পদ অনুগতদের দিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি, কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি দিয়েছেন অনুগতদের। মাদক ব্যবসায়ীরা থাকতেন তাঁর সভা-সমাবেশে। তাঁদের পদ-পদবিও দেন রাসেল। এ রকম বহু সুবিধাবাদীকে প্রতিষ্ঠা করে নেপথ্যে সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন রাসেলের স্ত্রী খাদিজা রাসেল। তবে এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যায় মতিউর রহমান মতি ও জাহিদ আহসান রাসেলের মোবাইল ফোন।