আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্রের হাওয়ায় দুলছে নৌকা
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশির ভাগই স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বড় বড় পদে রয়েছেন।
অনেক প্রার্থী কেন্দ্রীয় কমিটির বর্তমান ও সাবেক নেতা। কেউবা আবার সাবেক সংসদ সদস্য। কোনো কোনো প্রার্থী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ফলে সব প্রার্থীই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।
নিজস্ব কর্মী ও সমর্থকদের পাশাপাশি প্রার্থীদের ভোট ব্যাংক রয়েছে বলেও মনে করছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা । এমন কিছু আসনে চমক দেখাতে পারেন আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, আসন্ন নির্বাচনে ২৭টি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। ৩০০ সংসদীয় আসনে ভোটে মোট প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এক হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী।
“(এঁদের মধ্যে ৩৪৭ জন স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন)”।
সাধারণত দল থেকে যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয় তাঁর পক্ষেই স্থানীয় নেতাকর্মীদের কাজ করতে হয়। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপি ভোট বর্জন করেছে। তাই নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে এবং কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে স্বতন্ত্রেকে ছাড় দিতেহয়েছে আওয়ামী লীগকে। এই সুযোগে অনেক আসনে গুরুত্বপূর্ণ ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা সংক্রান্ত কমিটির কো-চেয়ারম্যান ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ দৈনিক দেশবাণীকে বলেন, ‘দলের কোন কোন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে জিতে আসতে পারেন—এমন কোনো সমীক্ষা বা আলোচনা হয়েছে কি না আমার জানা নেই।’
কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, নির্বাচনে যাঁরা ভোট পাবেন তাঁরাই জিতে আসবেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নিজেদের মতো কাজ করবেন। কর্মীরাও স্বাধীন, কারো ওপর কোনো চাপ নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ উৎসবমুখর নির্বাচন করাই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য।
এদিকে ফরিদপুরে ফের জাফর উল্যাহর মুখোমুখি নিক্সন
আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহকেই নৌকা প্রতীক নিয়ে আবারও পরীক্ষা দিতে হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের ঈগল প্রতীকের কাছে। ভাঙ্গা-সদরপুর ও চরভদ্রাসন নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-৪ আসনে গত দুইবার টানা দলের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে হেরেছেন কাজী জাফর উল্যাহ। যদিও ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেছিলেন।
এই আসনে টানা দুইবারের সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন। এর আগে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাননি তিনি। এবার মনোনয়ন চেয়েও পাননি। তাই আবার দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন।
“(বর্তমান এমপির প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক এমপি)”
গাজীপুর-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী বর্তমান এমপি মেহের আফরোজ চুমকির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক এমপি আখতারুজ্জামান। ট্রাক প্রতীকে নির্বাচন করছেন আখতারুজ্জামান। এই আসনে আরো সাত প্রার্থী থাকলেও স্থানীয় লোকজন বলছে, এই দুই প্রার্থীর মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি হবে।
মেহের আফরোজ চুমকি ১৯৯৬ সালে সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হন। তখন এই আসনে নির্বাচন করে এমপি হয়েছিলেন আখতারুজ্জামান। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে গেলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে মেহের আফরোজ চুমকিকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তার পর থেকে তিনিই দলের মনোনয়ন পেয়ে আসছেন।
মেহেরপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। এই আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের দুইবারের সাবেক এমপি আব্দুল মান্নান। তিনি ১৯৯১ সালের নির্বাচন এবং ১৯৯৯ সালের উপনির্বাচনে এমপি হয়েছিলেন। আব্দুল মান্নান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। এবার তিনি ট্রাক প্রতীকে নির্বাচন করছেন।
ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন আরেক সাবেক এমপি জয়নাল আবেদীন। তিনিও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। তিনি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। মেহেরপুর-১ আসনে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন সাবেক মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আব্দুল মমিন মণ্ডল। একই আসনে ছয়জন প্রার্থী থাকলেও তাঁদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেশি হবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আব্দুল লতিফ বিশ্বাস সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এরপর দুইবার তিনি আর দলের মনোনয়ন পাননি। এবার দলের মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন।
হবিগঞ্জ-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ সায়েদুল হক। তিনি ব্যারিস্টার সুমন নামেই বেশি পরিচিত। নানা সময় নানা বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কথা বলে পরিচিত হয়েছেন। ‘ওসির দেওয়া জয় বাংলা স্লোগান’ নিয়ে সমালোচনার জেরে আওয়ামী যুবলীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক পদ থেকে ২০২১ সালে তাঁকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সৈয়দ সায়েদুল হক (সুমন)। এই আসনে মোট প্রার্থী রয়েছেন আটজন। তবে এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিমান প্রতিমন্ত্রী মোঃ মাহবুব আলী। ভোটে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
ফরিদপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যবসায়ী নেতা আব্দুল কাদের আজাদ।
তিনি এ কে আজাদ নামে পরিচিত। আওয়ামী লীগের নৌকা না পেয়ে তিনি ঈগল প্রতীকে ভোট করছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী শামীম হক। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
পিরোজপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী নেই।
এই আসন শরিকদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। এখানে নৌকা প্রতীকে ভোট করছেন জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন (মঞ্জু)। এই আসনে মোট সাতজন নির্বাচন করছেন। শুরুতে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কানাই লাল বিশ্বাস।
তবে শরিককে আসন ছাড় দেওয়ায় তাঁর মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিতে হয়। কিন্তু ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থেকে যাচ্ছেন একমাত্র স্বতন্ত্র প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজ। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এই আসনে অন্য সবাই বিভিন্ন দলের প্রার্থী। ভোটে আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে মহিউদ্দিন মহারাজের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারে।
নাটোর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। এই আসনে তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন শফিকুল ইসলাম। তিনি সিংড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। জুনাইদ আহমেদ পলক জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। একবার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং দুইবার উপজেলা চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা শফিকুল ইসলামের দলে কোনো পদ নেই।
ফরিদপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুর রহমান।
এই আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন আওয়ামী কৃষক লীগের সাবেক সহসভাপতি আরিফুর রহমান দোলন। ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর। তিনি আগেও বিএনপি ও জাতীয় পার্টির হয়ে একবার করে এমপি হয়েছিলেন।
মানিকগঞ্জ-২ আসনে এবারও আওয়ামী লীগের প্রার্থী কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম। এর আগে একবার সংরক্ষিত এবং দুইবার ভোটে দাঁড়িয়ে তিনি সংসদ সদস্য হয়েছেন। আসন্ন নির্বাচনে মমতাজের মুখোমুখি চার স্বতন্ত্র প্রার্থী।
স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ভোটের মাঠ নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারো মতে এগিয়ে আছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম। আবার কেউ বলছে, লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। তবে মমতাজের ভোটের ভাগে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যে শরিক হবেন তাতে তেমন দ্বিমত নেই।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে আলোচনায় আছেন শিল্পপতি দেওয়ান জাহিদ আহমেদ। ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা জাহিদ আহমেদ জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক। জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফিন স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন এই আসনে।
সিংগাইর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন মুশফিকুর রহমান খান। কেটলি মার্কা নিয়েই তিনি জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার কারণে তাঁর নিজস্ব একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। ঈগল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোঃ সাহাব উদ্দিন আহম্মেদ। সাহাব উদ্দিনও মনে করেন, একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে তাঁর জনপ্রিয়তা বেশি। ওই অঞ্চলের বেশির ভাগ ভোট তিনিই পাবেন।
দুই পক্ষেই নিজ দলের গুরুত্বপূর্ণরা প্রার্থিতা পেয়েছেন
সিলেট-৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী টানা এমপি ও মন্ত্রী থাকলেও এলাকায় যাতায়াত কম—নুরুল ইসলাম নাহিদের নামে স্থানীয় লোকজনের এমন অভিযোগ। স্থানীয় লোকজন বলছে, এই দুই প্রার্থীতে ভোট কাটাকাটি হবে।
আসনটিতে তৃণমূল বিএনপির সমশের মবিন চৌধুরী এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী সেলিম উদ্দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সাবেক সচিব সমশের মবিন চৌধুরী চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়ে খালেদা জিয়ার পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হন। এখন তিনি তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন। হঠাৎ করেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ সমশের মবিনের পক্ষে নির্বাচনে নেমেছে। জাতীয় পার্টির প্রার্থী সেলিম উদ্দিন দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা। তিনি ২০১৪ সালে সিলেট-৫ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ঢাকা-১৯ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। এই আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি তালুকদার মোহাম্মদ তৌহিদ জং মুরাদ।
২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর পরিচিতি পান ডা. এনামুর রহমান। তখন এই আসনে এমপি ছিলেন জং মুরাদ। পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে মুরাদ জং আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। এনামুর রহমানকে নৌকার প্রার্থী করা হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হলে তাঁকে সরকারের প্রতিমন্ত্রী করা হয়। এবারের নির্বাচনে সাভার-আশুলিয়ায় ঈগল প্রতীকে নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছেন তিনি।