রাজধানীর গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর বাবা আবদুস সাত্তারের আহাজারি। তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন প্রতিবেশী ও স্বজনেরা। রোববার দুপুরে নকলা উপজেলার নারায়ণখোলা পশ্চিমপাড়া আবদুস সাত্তার এর পরিবারের কান্নার আহাজারিতে ভেঙে পড়ে পুরো এলাকা ।
আবদুস সাত্তার দৈনিক দেশবানী কে জানাই ‘আমার কলিজার বাপধন ডেঙ্গু পরীক্ষা করবার লাইগ্যা ঢাকা গেছিল। শুক্কুরবার সকালবেলা ফোন কইরা আমার কাছে তিন হাজার টাকাও চাইছে। ঐ টাকা তো আর পাঠাইবার পাইলাম না। ও আল্লাহ, আমার স্বর্ণের চাক্কারে তুমি কই নিয়া গেলা? আমার কইলজার টুকরারে ছাড়া আমি অহন কেমনে থাকমু? মরার তিন দিনেও আমার বাপধনরে দেখবার পাইলাম না গো। তুমি আমারেও তুইল্লা নাও আল্লাহ।’
এভাবেই ছেলে রেজাউলের মৃত্যুর খবর শুনে আহাজারি করছেন মা রেনুজা বেগম (৪৫)। গত শুক্রবার ঢাকায় আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ থেকে ফেরার পথে গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন পথচারী হাফেজ রেজাউল (২১)। তিনি শেরপুরের নকলা উপজেলার চরঅষ্টধর ইউনিয়নের নারায়ণখোলা পশ্চিমপাড়া গ্রামের বর্গাচাষি আবদুস সাত্তারের বড় ছেলে। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর একটি মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস বিভাগের ছাত্র ছিলেন রেজাউল।
ঐ দিন সংঘর্ষে আহত হয় আরো চার জন।
চারজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
গতকাল শনিবার সকালে রেজাউলের চাচা আজাহারুল ইসলামের মুঠোফোনে তাঁর মৃত্যুর খবর দেয় নকলা থানা-পুলিশ।
পুলিশ তাঁদের ঢাকায় গিয়ে রেজাউলের লাশ আনতে অনুরোধ করে। হঠাৎ ছেলের মৃত্যুর খবরে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন রেজাউলের মা–বাবা। এ ছাড়া তিন দিনেও ছেলের লাশ না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এদিকে এলাকাবাসীরা দৈনিক দেশবানী কে জানান, নম্র-ভদ্র সদালাপী রেজাউল রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। ময়মনসিংহের জামিয়া ফয়জুর রহমান মাদ্রাসা থেকে পড়া শেষ করে ঢাকায় দাওরায়ে হাদিস পড়তে যান। কোরবানির ঈদের কয়েক দিন আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে আসেন। পরে গত বৃহস্পতিবার ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য আবার ঢাকায় যান।
রোববার দুপুরে নিহত রেজাউলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা মিরগী নদীর পাড় ঘেঁষে রেজাউলদের বাড়ি। বাড়ির পাশে নারায়ণখোলা পশ্চিম আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়। আশপাশে আর কোনো ঘরবাড়ি নেই। বাড়ির দক্ষিণে বাঁশঝাড়ে পারিবারিক কবরস্থানে রেজাউলের জন্য কবর খোঁড়া হয়েছে। তার পাশে কবরের জন্য চাটাই তৈরি করছেন এক ব্যক্তি ।
বাড়িতে ঢুকতেই দেখা গেল, ছেলের শোকে মাতম করছেন মা রেনুজা বেগম। তাঁকে ঘিরে আছেন এলাকাবাসী ও স্বজনেরা। বাবা আবদুস সাত্তার বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। প্রতিবেশীরা পানি ছিটিয়ে তাঁকে সুস্থ করার চেষ্টা করছেন। রেজাউলের বড় দুই বোন ও মামা লাশ আনতে ঢাকায় গেছেন। লাশ আনতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেছেন। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত তাঁরা লাশ বুঝে পাননি বলে জানান।
ছেলের কথা বলতেই আবদুস সাত্তার বুক চাপড়ে বলতে থাকেন, ‘কত কষ্ট কইরা লেহাপড়া (লেখাপড়া) করাইতাছি। শুক্রবার দুপুরেও মোবাইলে কথা হইল। পুলাডা ডেঙ্গু পরীক্ষা করব বইলা তিন হাজার টাকাও চাইছে। জুম্মার দিন বাজারের দোকান বন্ধ আছিল বইলা পাঠাবার পাই নাই। পরদিন সকালে তো শুনি বাপ আমার নাই। আমার বাপের কী দোষ, ও তো কোনো দল করত না। তাইলে কেন অরে মারল? আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করি, আমার পুলারে যারা মারছে, আপনে তাদের সঠিক বিচার করবাইন।’
প্রতিবেশী ও স্বজন বন্দেজ আলী বলেন, সব সময় হাসিখুশি রেজাউল কোনো সাতপাঁচে ছিলেন না। তাঁর ছোট ভাইও হাফেজ। রাজনীতি করতেন না। রোজার মাসে স্থানীয় মসজিদে খতম তারাবি পড়ান। এই ছেলে বিনা কারণে মারা গেলেন। অথচ চেয়ারম্যান ছাড়া প্রশাসনের কোনো লোক বা জনপ্রতিনিধি খোঁজও নিলেন না।
নিহত রেজাউলের মায়ের আহাজারি।
ছেলের মৃত্যুর খবরে বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন মা রেনুজা বেগম। রোববার দুপুরে নকলা উপজেলার নারায়ণখোলা পশ্চিমপাড়া চরঅষ্টধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম রাব্বানী দৈনিক দেশবানী কে বলেন, রেজাউল অত্যন্ত ভদ্র ও ধার্মিক ছেলে ছিলেন। তাঁর বাবা অনেক কষ্ট করে তাঁকে পড়াশোনা করাচ্ছিলেন। রেজাউল রাজনীতি করতেন না। রেজাউলের এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া সত্যি খুবেই কষ্টের।