রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির শুক্রবারের মহাসমাবেশকে ঘিরে পুলিশের গ্রেপ্তার-ধরপাকড় অব্যাহত থাকার অভিযোগ করেছে দলটি। পুলিশের এই অভিযানে গ্রেপ্তার অন্তত ৪৪৭ জনকে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়। তাঁদের মধ্যে ৯৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ভবঘুরে, অভ্যাসগত অপরাধী বা কোথাও একত্র হওয়ার বিষয়ে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না দিতে পারার অভিযোগে।
রাজধানীর ধানমন্ডি, বংশাল ও কোতোয়ালি থানার পুলিশ এই ৯৬ জনকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪, ৫৫ ও ১৫১ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে নেয়। পরে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।
ঢাকায় ঢোকার পথগুলোতে পুলিশের তল্লাশি-জেরা, হয়রানি-ভোগান্তি
রাজধানীতে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে পুলিশ অবস্থান নেয় সড়কের বিভিন্ন স্থানে। সড়কে গাড়ি থামিয়ে না রাখার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালককে তাগাদা দিচ্ছেন এক পুলিশ সদস্য। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় দুপুর পৌনে ১২টায় । ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার ভাষ্য হলো, সন্দেহের বশবর্তী হয়ে পরোয়ানা ছাড়া যেকোনো ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারবে। ৫৫ ধারা অনুযায়ী, ভবঘুরে, অভ্যাসগত অপরাধে জড়িত ব্যক্তিকে বিনা পরোয়ানায় পুলিশের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা রয়েছে। ১৫১ ধারার ভাষ্য হলো, আমলযোগ্য অপরাধের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারলে পরোয়ানা ছাড়াই যেকোনো ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারবে।
বিএনপির আন্তর্জাতিক-বিষয়ক সম্পাদক ও আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার গতকাল রাতে দৈনিক দেশবানী কে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪, ৫৫ ও ১৫১ ধারায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে হয়রানি করছে সরকার। যাঁর সুনির্দিষ্ট পেশা আছে, যিনি সম্মানিত মানুষ, তাঁকেও ভবঘুরে-অভ্যাসগত অপরাধী হিসেবে আদালতে সোপর্দ করা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
থানা-পুলিশ ও মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, গত বুধবার রাত ১০টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) মতিঝিল বিভাগ নয়াপল্টনের হোটেল মিডওয়েতে দুই ঘণ্টা ধরে অভিযান চালায়। সেখান থেকে ৪৩ জনকে আটক করে পুলিশ। পরে তাঁদের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫১ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়।
৪৩ আসামির ব্যাপারে ডিবির উপপরিদর্শক (এসআই) ভজন বিশ্বাস আদালতের কাছে লিখিতভাবে বলেন, তাঁরা অসৎ উদ্দেশ্যে হোটেল মিডওয়েতে অবস্থান করে আমলযোগ্য অপরাধ করার জন্য একত্র হয়েছিলেন।
গত বুধবার রাতে ১০ জনকে ধানমন্ডির ৬ নম্বর সড়কের ২৯ নম্বর বাসার নিচতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন চুয়াডাঙ্গার আসিরুল ইসলাম (৫২), মাসুদ পারভেজ (৫২), আবুল কালাম আজাদ (৪৩), শরিফুর জামান ওরফে সিজার (৪৪), রাজশাহীর আনোয়ার হোসেন (৫২), মিজানুর রহমান (৪৬), লুৎফর রহমান (৩৫), আক্তারুজ্জামান (৪২), সফিকুল হক মিলন (৫৫) ও কুষ্টিয়ার টিপু সুলতান (৫৬)।
ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম গতকাল রাতে দৈনিক দেশবানী কে বলেন, ডিবির সহায়তায় বুধবার রাতে এই ১০ জনকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ব্যাপারে ডিবির পরিদর্শক এ কে এম মাহবুবুল আলম গতকাল লিখিতভাবে আদালতকে বলেন, গত বুধবার দিবাগত রাত ১টা ১০ মিনিটের দিকে ধানমন্ডির ৬ নম্বর সড়কের ২৯ নম্বর বাসায় কতিপয় লোকজন একত্র হন। তাঁরা কোনো ধর্তব্য অপরাধ করেছেন বা করতে পারেন—এমন সন্দেহে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে, গভীর রাতে বিভিন্ন জেলার লোকজন এক জায়গায় একত্র হওয়া সম্পর্কে তাঁরা কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
রাজধানীর বংশাল ও কোতোয়ালি থানার পুলিশ ৪৩ জনকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল ঢাকার আদালতে পাঠায়। পরে তাঁদের কারাগারে পাঠান আদালত।
এদিকে ঢাকায় ঢোকার মুখে ৩টি তল্লাশিচৌকিতে মধ্যরাতে মহাসড়কে বাস থামিয়ে যাত্রীদের নানা প্রশ্নে জেরা করতে থাকেন পুলিশ সদস্যরা। একপর্যায়ে শুরু করেন মুঠোফোন তল্লাশি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর পার্শ্ববর্তী ধউর বেড়িবাঁধ মোড়ে
গ্রেপ্তার ৪৩ জনের মধ্যে কয়েকজনের নাম-পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন বরিশালের ইউসুফ আলী (৩৬), লক্ষ্মীপুরের ফয়জুল ইসলাম (৩২), চাঁদপুরের বিল্লাল (৩০), সেনবাগ থানা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মেহেদী আহম্মেদ, ঝিনাইদহ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুজ্জামান (৪০), ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক তৌফিকুর রহমান (৫২), ঝিনাইদহ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আজিজুল হক (৪৪), ফেনীর পরশুরাম থানা যুবদলের আহ্বায়ক সামসুল আলম (৪০), কামরাঙ্গীরচরের সফিউদ্দিন (৫০) ও পরশুরাম পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল আফসার চৌধুরী (৩৫)।
এ ব্যাপারে বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ জয়নুল আবেদীন গতকাল রাতে দৈনিক দেশ বাণীকে বলেন, তাঁদের মহাসমাবেশকে ঘিরে দলীয় নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি-হয়রানির জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪, ৫৫ ও ১৫১ ধারার অপব্যবহার করছে পুলিশ। বিএনপির গ্রেপ্তার হওয়ার এসব নেতা-কর্মী মহাসমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন।
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ গতকাল রাতে দৈনিক দেশ বাণীকে বলেন, ৫৪ ধারায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের কোনো তথ্য তাঁর জানা নেই।
এদিকে আইনজীবী ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, নাশকতার বিভিন্ন অভিযোগে করা নতুন-পুরোনো মামলায় ঢাকার দারুস সালাম থানার পুলিশ ৫৫ জনকে, কাফরুল থানা ৩৯ জন, পল্লবী থানা ৩২ জন, যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা থানা ১৮ জন, সূত্রাপুর থানা ১৯ জন, ওয়ারী থানা ৭ জন, খিলক্ষেত থানা ৩ জন, ক্যান্টনমেন্ট থানা ৩ জন, কলাবাগান থানা ৬ জন, মোহাম্মদপুর থানা ৯ জন, আদাবর থানা ২ জন, তেজগাঁও থানা ১ জন, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা ৪ জন, হাতিরঝিল থানা ৭ জন, সবুজবাগ থানা ১ জন, রামপুরা থানা ২ জন, রমনা থানা ৩ জন, শাহবাগ থানা ১০ জন, পল্টন থানা ৮ জন, মতিঝিল থানা ২ জন, বনানী থানা ১৫ জন, গুলশান থানা ১১ জন, বাড্ডা থানা ১৩ জন, ভাটারা থানা ৩ জন, বংশাল থানা ৯ জন, কোতোয়ালি থানা ২ জন, লালবাগ থানা ৯ জন, কামরাঙ্গীরচর থানা ১৫ জন, শ্যামপুর ও কদমতলী থানা ১৮ জন, তুরাগ থানা ১০ জন, উত্তরা পশ্চিম থানা ২ জন, উত্তরখান থানা ৬ জন, খিলগাঁও থানা ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।
অপরদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন দৈনিক দেশ বাণীকে বলেন, নাশকতার অভিযোগে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, পুলিশ কেবল তাঁদেরই গ্রেপ্তার করেছে। নিরীহ কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।
এদিকে বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে গ্রেপ্তার হওয়া দলের নেতা-কর্মীদের গতকাল প্রিজন ভ্যানে সিএমএম আদালতে আনা হয়। বুধবার রাতে খিলগাঁও থেকে গ্রেপ্তার মিঠুন আহমেদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছেন তাঁর এক স্বজন। গতকাল দুপুরে
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক গতকাল দৈনিক দেশ বাণীকে বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-গ্রেপ্তারকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এখন এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে আগামী নির্বাচনের ছয় মাস আগে থেকেই সরকার একই হাতিয়ারের প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছে।