রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় গত এক বছরে সন্ত্রাসীদের হাতে কমপক্ষে ২২ জন নিহত হয়েছেন। গত বুধবার রাতে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন রাঙামাটির বিলাইছড়ি বড়থলিপাড়া এবং বান্দরবানের রুমা উপজেলার বথি ত্রিপুরাপাড়ার কাছাকাছি একটি দুর্গম এলাকায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি এবং সেনাবাহিনীর একজন সদস্য নিহত ও অন্য একজন আহত হওয়ার ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি আবারও আলোচনায় এসেছে। পাহাড়েও আতঙ্ক ও নিরাপত্তহীনতা বেড়েছে।
ওই গোলাগুলিতে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের মধ্যে যে তিনজন নিহত হয়েছে, তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মূল অংশের সশস্ত্র ক্যাডার বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
স্থানীয় লোকজনও বলছে, ওই তিনজনকে তারা জনসংহতি সমিতির মূল অংশের সদস্য বলেই চেনে। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতি বরাবরের মতোই দাবি করছে, তাদের সশস্ত্র কোনো শাখা নেই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি গতকাল শুক্রবার এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সেনাবাহিনীর ওপর হামলাকারীরা যাদের সমর্থকই হোক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি এর দায় এড়াতে পারবে না। ’
তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীর পক্ষে জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এ অঞ্চলে শান্তি-শৃখলা রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, চুক্তির অন্যতম পক্ষ হিসেবে এই দায়িত্ব জনসংহতি সমিতিরও।
মন্ত্রী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জনসংহতি সমিতির সদস্যদের কাছে থাকা সব ধরনের বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরকারের কাছে জমা দেওয়ার কথা।
তিনি প্রশ্ন করেন, সে সময়ে সব অস্ত্র জমা দেওয়া হলে নতুন করে অস্ত্রের ঝনঝনানি হচ্ছে কেন?
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিপরবর্তী সরকারের শান্তি উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে দাবি করে মন্ত্রী বলেন, সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য নয়, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই নিজেরা নিজেরাই উপদলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছে জনসংহতির সদস্যরা।
এমনই একটি পরিস্থিতিতে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে সেনাবাহিনীর একজন সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসারকে। অন্যদিকে প্রলোভনের শিকার হয়ে ভুলপথে পা বাড়িয়ে প্রাণ দিতে হচ্ছে সম্ভাবনাময় যুবশক্তিকেও।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে সন্ত্রাসমুক্ত করার লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র উদ্ধারের একটি বিশেষ অভিযান দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
গত এক বছরে যা ঘটেছে : গত এক বছরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় কমপক্ষে ২২ জন নিহত হয়েছে। অস্ত্রসহ আটক হয়েছে ৩২ জন। বিপুল পরিমাণ ভারী মারণাস্ত্রের গুলি, একে-২২ রাইফেল, একে-৪৭সহ বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম উদ্ধার এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য অন্তত ১০ বার গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে পাহাড়ে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজির কারণেই প্রাণহানির ঘটনাগুলো ঘটছে বলে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ।
গত ২৬ ডিসেম্বর ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি এলাকার বাসিন্দা আপেল ত্রিপুরা অমিত (৩৩) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তাঁর কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও চার রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। তাঁর দেওয়া তথ্যে ২৭ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে উদ্ধার করা হয় ১৫টি মর্টার শেল, ২৫টি বুস্টার ও ৫১০ রাউন্ড অটো মেশিনগানের গুলি। এ ধরনের অস্ত্র ও গুলি সাধারণত সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে থাকে। এতে প্রশ্ন ওঠে, এসব অস্ত্র ও গুলি কি পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপের জন্য ভিন্নপথে আনার অপচেষ্টা হচ্ছিল?
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৪ বছর পূর্তির দুই দিন আগে গত ৩০ নভেম্বর সর্বশেষ নিহত হন রাঙামাটির বন্দুকভাঙ্গায় আবিষ্কার চাকমা। ২৩ নভেম্বর বান্দরবানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আওয়ামী লীগের নেতা উথোয়ানু মারমা নিহত হন। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী গুলিবিদ্ধ হন। ১৬ অক্টোবর কাপ্তাই চিত্মরমে আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী নেথোয়াই মারমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সেপ্টেম্বরে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুজন নিহত হয়। ওই মাসেই বান্দরবানের চন্দ্রঘোনা সড়কের আমবাগান এলাকায় যাত্রীবোঝাই একটি চাঁদের গাড়িতে গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। এতে ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনায় ২৩ জনকে আসামি করে মামলা হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য ও জেএসএস নেতা কে এস মং মারমাও রয়েছেন। আগস্টে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার ইছাছড়ি এলাকার পাহাড়ের ঢালুতে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
জুলাই মাসে তিন জেলায় সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয় চারজন। এ ছাড়া বান্দরবান সীমান্তে অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। জুন মাসে নিহত হয় তিনজন।
প্রতি মাসেই এ ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সেনাবাহিনীর সঙ্গেও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে।
গত বছর ২৮ এপ্রিল বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। পরে সন্ত্রাসীদের আস্তানা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি, সেনা আদলে পোশাক, চাঁদার রসিদসহ সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া বছরজুড়ে অস্ত্র উদ্ধার ও আটক করা হয় প্রায় ৩০ জনকে।