আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজধানীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় নৈরাজ্য চলছে। চুক্তিতে দুই-তিনগুণ বেশি ভাড়ায় অটোরিকশা চালানো হচ্ছে। এমন নৈরাজ্যে যাত্রীদের রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে। অথচ আইন অনুযায়ী-যাত্রীর ইচ্ছামতো মিটারেই অটোরিকশার গন্তব্যে যাওয়ার কথা।
এ আইন ২০ বছরেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমানে অটোরিকশায় ভাড়া নৈরাজ্য আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। অটোরিকশার এমন নৈরাজ্য প্রতিরোধে ট্রাফিক বিভাগের তৎপরতাও তেমন একটা চোখে পড়ে না বলে যাত্রীদের অভিযোগ। তবে ট্রাফিক পুলিশ বলছে-এ নৈরাজ্য বন্ধে তাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ বলছে-রাজধানীতে মাত্র দুই শতাংশ অটোরিকশা মিটারে চলে। মিটারে চলা অটোরিকশার ৯২ শতাংশ ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া বা বকশিস দাবি করে। তবে বৃষ্টি বা সরকারি ছুটির আগের দিন অথবা গণপরিবহণ সংকটকালে এ বকশিশের পরিমাণ ১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। এছাড়া যাত্রীদের চাহিদামতো গন্তব্যে যেতে রাজি হয় না ৮৮ শতাংশ অটোরিকশা চালক।
চুক্তিতে চলাচলকারী অটোরিকশা চালক মিটারের ভাড়া থেকে সর্বনিু ৫০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৭১০ দশমিক ৮১ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে অটোরিকশা নৈরাজ্য বন্ধ করা সম্ভব। সরকার চাইলে এক সপ্তাহের মধ্যে সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ করে এ খাতকে সুশৃঙ্খল করা সম্ভব।
তিনি বলেন, ২০০৮ সালের সড়ক আইনে অটোরিকশা মিটারবিহীন চললে চালককে ছয় মাসের জেল এবং মালিককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানার কথা স্পষ্ট উল্লেখ আছে। এ আইনের প্রয়োগ করা গেলে নৈরাজ্য থাকবে না। যাত্রী ভাড়া পাঁচবার এবং জমা (মালিকপক্ষ) তিন দফা বাড়ানো হয়েছে। এমন সুবিধা দেওয়ার পরও অটোরিকশা খাতটি বিশৃঙ্খল রয়ে গেছে।
এ বিষয়ে শনিবার বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, সড়ক আইন অনুযায়ী চুক্তিতে চলাচলকারী সিএনজি অটোরিকশার বিরুদ্ধে বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত অব্যাহত আছে। কোনো অটোরিকশা চালক মিটারে না চললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সীমিত জনবল দিয়েও এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সঙ্গেও এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করছি। তিনি আরও বলেন, যাত্রীদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবুর রহমান বলেন, মিটার ছাড়া সিএনজি অটোরিকশা চলা নিয়ে শাস্তির বিষয়ে সড়ক আইনে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। এ কারণে সিএনজি চালকদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। তিনি আরও বলেন, সিএনজি অটোরিকশা যান্ত্রিক যানবাহন নয়। আবার অযান্ত্রিকও বলা যায় না। ফলে বিভ্রান্তি রয়েছে। মিটারে চালাতে চালকদের বাধ্য করতে আইনি কাঠামোর আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, মিটারে না গিয়ে চুক্তিতে যাওয়ার কোনো ঘটনা নজরে এলে অন্যভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কখনো কখনো ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজার ব্যবস্থাও করা হয়, গাড়ি ডাম্পিং করা হয়। কেউ অভিযোগ করলে অটোরিকশার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তবে ট্রাফিক পুলিশ ধরলে বেশির ভাগ সময় যাত্রীরা বলে, তারা মিটারে যাচ্ছে। এ কারণে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
সরেজমিন দেখা গেছে, মিটারে যাওয়ার নিয়ম থাকলেও সিএনজি অটোরিকশা চালকরা যাত্রীদের সঙ্গে চুক্তি করে গন্তব্যে যাচ্ছেন। যে গন্তব্যে মিটারের ভাড়া আসে ১০০ থেকে ১২০ টাকা সেখানে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। চুক্তিতে যাত্রী তুললেও মিটার চালু করেই পথ চলেন চালকরা। আবার যাত্রীদেরও বলে দেন, ট্রাফিক পুলিশ ধরলে বলবেন মিটারে যাচ্ছি। আর চালক মিটারে যেতে রাজি হলেও মিটারের চেয়ে বাড়তি কমপক্ষে ৫০ টাকা বকশিশ চাওয়া হয়।
শুক্রবার আজিমপুরে সিএনজি অটোরিকশা খুঁজছিলেন মহাখালীর বাসিন্দা জামিল হোসেন। তার দাবি, আটটি সিএনজি অটোরিকশা চালকের সঙ্গে কথা বলেও কাউকে তিনি মিটারে যেতে রাজি করাতে পারেননি। তার গন্তব্যের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। যেখানে মিটারে ভাড়া সর্বোচ্চ ১৪০ টাকা আসার কথা। কিন্তু চালক ভাড়া চান ৪০০ টাকা।
শাহবাগ মোড় থেকে যাত্রাবাড়ী যাওয়ার জন্য সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করার চেষ্টা করছিলেন আল আমিন হক। তিনি জানান, একটি সিএনজি অটোরিকশাও মিটারে যেতে চাচ্ছে না। চুক্তিতে একেকজন ভাড়া দাবি করছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। ৫০ টাকা বাড়িয়ে মিটারে যেতে চাইলেও কেউ রাজি হচ্ছে না। তার গন্তব্যের দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। এ দূরত্বে সর্বোচ্চ ভাড়া আসার কথা ১০০ থেকে ১১০ টাকা। তিনি বলেন, দিনদুপুরে আমাদের পকেট কাটা হচ্ছে। কিন্তু এ নৈরাজ্য কেউ দেখে না।
শাহবাগ মোড়ে সিএনজি চালক আব্দুল আলী বলেন, যাত্রীদের অনেকেই মিটারের নাম ভুলে গেছে। সবাই এখন চুক্তিতে চলে। তারা এসে আগে জিজ্ঞেস করে ভাড়া কত। আমাদের যেভাবে পোষায়, আমরা সেভাবেই ভাড়া চাই।
তিনি বলেন, মিটারে গাড়ি চালাতে হলে আগে সরকার ও মালিকদের ঠিক হতে হবে। মালিকরা তো সরকারের আইন মানে না। সরকার দৈনিক জমার হার বেঁধে দিয়েছে ৯০০ টাকা। অথচ একবেলা গাড়ি চালিয়ে মালিককে দিতে হয় ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা। আরেক বেলা যে চালায় তার কাছ থেকেও একই পরিমাণ টাকা আদায় করা হয়। এরপর অনেক গাড়ির কাগজ ঠিক না থাকায় রাস্তায় পুলিশ ধরলে টাকা-পয়সা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়। রাস্তায়ও থাকে জ্যাম, বেশি ট্রিপও নেওয়া যায় না।
ফার্মগেটে সিএনজি অটোরিকশা চালক জালাল বলেন, মেট্রোরেলের খোঁড়াখুঁড়ি ও যানজটে এমনিতেই আমাদের অবস্থা খারাপ। মিটারে চললে পেটে ভাত জুটবে না। ফার্মগেটে ১১টি সিএনজি অটোরিকশা চালকের সঙ্গে কথা হয়। তাদের কেউই মিটারে যেতে রাজি হয়নি।
গাবতলী বাস টার্মিনালের পাশে সিএনজি অটোরিকশা খুঁজছিলেন জাহির আলম। কলাবাগানে তিনি যাবেন। অটোরিকশা থাকলেও চালকদের কেউ মিটারে যেতে রাজি হননি। চুক্তিতে তারা ৩৫০ টাকা ভাড়া হাঁকেন। চালকদের অজুহাত-মিটারে গেলে তাদের পোষাবে না। সিএনজি অটোরিকশায় না গিয়ে জাহির অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল কল করেন। তিনি বলেন, অ্যাপে বিল দেখাচ্ছে ১২০ টাকা। এতে আমার ২৩০ টাকা বাঁচবে।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি সূত্র জানায়, অটোরিকশা খাতকে এ নৈরাজ্য থেকে শৃঙ্খলায় আনতে তারা সাত দফা সুপারিশ করেছিল। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে-ঢাকা ও চট্টগ্রাম উভয় মহানগরীতে ২০ হাজার করে ৪০ হাজার নতুন অটোরিকশা নামানো; গণমালিকানার পরিবর্তে কোম্পানিভিত্তিক অথবা অ্যাপসভিত্তিক অটোরিকশা পরিচালনার ব্যবস্থা করা; মিটারবিহীন ও ‘প্রাইভেট’ অটোরিকশা চলাচল বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া; জমা ও ভাড়া বৃদ্ধি, সিলিং নির্ধারণ, মনিটরিং কমিটিতে যাত্রী প্রতিনিধি রাখা; নীতিমালা লঙ্ঘন করে চলাচলকারী অটোরিকশা এক বছর আটকে রাখার বিধান করা; আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করা এবং নতুন অটোরিকশা নিবন্ধনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। যাত্রীকল্যাণ সমিতির দাবি-এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে এ খাতের নৈরাজ্য নিরসন করা সম্ভব।
উল্লেখ্য, ২০০২ সালের শেষ দিক থেকে ঢাকা শহরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রায় ১৩ হাজার অটোরিকশার নিবন্ধন দেয়।