৩০ বছর আগে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়ার পর অভিমান করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান কিশোর সফিউল আলম। পরে পথ ভুলে হারিয়ে যান। পরিবারের লোকজন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো সন্ধান পাননি।
১৫ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া সেই সফিউল হঠাৎ তার ১৮ বছরের ছেলেকে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। নিখোঁজের ৩০ বছর পর বাড়িতে ফিরে আসায় সফিউলের পরিবার ও স্বজনদের মাঝে আনন্দের বন্যা বইছে। তাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভুট্টোজোত পাঠানপাড়া এলাকায় গত বুধবার রাতে বড় ভাই ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে ফেরেন সফিউল। এ সময় হারিয়ে যাওয়া ছোট ভাইকে বড় ভাই ও ভাবিরা ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেন। পাশাপাশি ছোটবেলার বন্ধুরাও সফিউলকে বরণ করে নেন। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে তাকে দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন লোকজন।
জানা গেছে, সফিউল আলম তেঁতুলিয়া উপজেলা দেবনগর ইউনিয়নের ভুট্টোজোত পাঠানপাড়া এলাকার আকবর আলীর দ্বিতীয় ছেলে। কৃষক বাবার ৬ ভাইবোনের মধ্যে সফিউল দ্বিতীয়।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৯৯২ সালে হঠাৎ করে দরিদ্র কৃষক বাবার পরিবারের অভাব অনটন ও ভরণপোষণ নিয়ে সফিউলের সঙ্গে বড় ভাই ইসমাইলের ঝগড়া ও কথা কাটাকাটি হয়। পরে ভাইয়ের সঙ্গে অভিমান করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান সফিউল। বাসে উঠে চলে যান ঠাকুরগাঁও। পরে কিশোর সফিউল সেখান থেকে দিনাজপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার যান।
এদিকে বিভিন্ন জেলায় খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান না পাওয়ায় সফিউল বেঁচে নেই বলে ধারণা ছিল তার পরিবারের। ছেলে হারানো শোকে মারা যান সফিউলের মা সপিলা বেগম।
কক্সবাজারের চকোরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের হাজিয়ান এলাকায় এক চেয়ারম্যানের বাড়িতে ১২ বছর কৃষি শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন সফিউল। ওই চেয়ারম্যানের মৃত্যুর পর আশপাশের এলাকার কৃষিক্ষেতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন তিনি।
সেখানে দীর্ঘ দিন শ্রমিকের কাজ করার পর স্থানীয়রা সবাই মিলে তাকে বিয়েও করিয়েছেন। বিয়ের পর ক্ষেতমজুরে শ্রমিকের কাজ করে ১০ শতক জমি নিয়ে বাড়ি করেন। স্ত্রী সাকিলা বেগমসহ তিন ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে তার পরিবার।
সফিউল বাড়ির পথ না চিনলেও সন্তানদের প্রায় বাড়ির কথা বলত ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, পঞ্চগড় এলাকায়। পরে বড় ছেলে তাওহিদুল ইসলাম তাকে নিয়ে দাদাবাড়ির ঠিকানা খোঁজার জন্য বের হয়। তারা প্রথমে পঞ্চগড় আসেন। দশমাইল নামক বাজারে গেলে সফিউলের সেই বাজারের স্মৃতি মনে পড়ে। সফিউল তার বাবা, মা, ভাই বা গ্রামের নাম বলতে না পারলেও তার বড় দুলাভাই ও বোনের নাম বলতে পারত।
দশমাইল বাজারে ভগ্নিপতির নাম বলার পর স্থানীয়রা তার বাড়িতে নিয়ে যায়। এ সময় বড় বোন ও দুলাভাই সফিউলকে চিনতে পারে। পরে ভাইদের খবর দিলে তারা তাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন।
সফিউলের বড় ভাই ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমার মেজো ভাই অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। তাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। কিন্তু সন্ধান পাইনি। হঠাৎ করে আদরের ভাইকে খুঁজে পেয়ে আমরা অনেক আনন্দিত।’
সফিউল আলম বলেন, অভিমান করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আমার কিছুই মনে পড়ত না। তবে যখন পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে ভাষা শুনতাম তখন মনে হতো আমার বাড়ি এদিকে। অনেক চেষ্টা করছি বাড়িতে আসার জন্য কিন্তু ঠিকানা বলতে বা পারায় আসতে পারিনি। ছেলেমেয়েদের জন্মসনদের কাগজপত্র প্রয়োজন। তাই সাহস করে বড় ছেলেকে নিয়ে প্রথম পঞ্চগড়ে আসি।
তিনি বলেন, দশমাইল বাজারে আসার পর মনে পড়ে ওই এলাকায় আমার বড় বোনের বাড়ি। বাজারে দুলাভাইয়ের নাম বললে মানুষজন তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। পরে আমার বড় ভাই আমাকে পৈতৃক ভিটায় নিয়ে আসে। হারানো ভাই-বোনদের পেয়ে আমি অনেক আনন্দিত। আমি তাদের সঙ্গে থাকতে চাই। কিন্তু ঘরবাড়ি তৈরি করার মতো কোনো সামর্থ্য নেই। তাই সরকার যদি সহযোগিতা করত তাহলে অনেক উপকার হতো।
তেঁতুলিয়া উপজেলার ৭নং দেবনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সলেমান আলী বলেন, সফিউল স্থায়ীভাবে পৈতৃক ভিটায় ভাইদের সঙ্গে বসবাস করতে চাইলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।