করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকার হোটেল-রেস্তোরাঁয় টিকার সনদ দেখানো বাধ্যতামূলক করলেও তা মানা হচ্ছে না। বেশির ভাগ জায়গায় সনদ না দেখেই ভোক্তাদের কাছে খাবার বিক্রি করা হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ হোটেল-রেস্তোরাঁয় স্বাস্থ্যবিধিরও বালাই নেই। গাদাগাদি করে বসে এসব রেস্তোরাঁয় খাবার খাচ্ছেন মানুষ। তবে হোটেল-রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষের দাবি, দেশের সব মানুষ এখনো টিকা পায়নি, তাই নির্দেশনা কার্যকর করা যাচ্ছে না। আবার অনেকেই এ নির্দেশনা সম্পর্কে এখনো জানেনই না।
হোটেল-রেস্তোরাঁ মালিকরা জানান, সারা দেশে এ খাতে ৩০ লাখের বেশি শ্রমিক রয়েছেন। যাদের ৩০ শতাংশ এখনো টিকা নিতে পারেননি। ফলে তারা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। এসব শ্রমিকের কারও জন্মসনদ নেই, কারও নেই জাতীয় পরিচয়পত্র। যে কারণে তারা টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারছেন না।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, টিকার সনদ দেখে সেবা দেওয়ার নির্দেশনাটাই বাস্তবসম্মত নয়। তারপরও সরকার যেহেতু নির্দেশনা দিয়েছে, আমরা সেই নির্দেশনা প্রতিপালনের চেষ্টা চালাচ্ছি। তিনি বলেন, বাস্তবে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানার পরিস্থিতি নেই। ভোক্তাদেরও টিকার কার্ড প্রদর্শন করানোর কোনো সিস্টেম নেই।
হোটেলে খাবার খেতে এলে অনেকেই পরিবার নিয়ে আসেন। এক পরিবারের ৫ জন সদস্য এলেন, তাদের টিকার সনদ দেখতে গেলে দেখা যাবে দুজন টিকা নেননি। তখন তো ওই কাস্টমারকে সেবা না দিয়ে বের করে দেওয়া যায় না। তিনি বলেন, আমরা যদি টিকার সনদের বিষয়ে কঠোর হই, তবে হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাস্টমাররা খেতে আসবে না। আমাদের ব্যবসা লাটে উঠবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের ছোট ছোট হোটেলে তিন বেলা খেয়ে থাকেন দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীর স্বজনরা।
অনেক রোগীর খাবারও হাসপাতালে যায় এখান থেকেই। সেখানকার হোটেলগুলোর মালিক ও কর্মচারীরা টিকার সনদ দেখে খাবার পরিবেশন তো দূরের কথা, নিজেরাই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। রোববার রাজধানীর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, নিউমার্কেট, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ডেমরা, উত্তরা, দক্ষিণখান, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় যুগান্তর প্রতিনিধিরা সরেজমিন ঘুরে এ ধরনের চিত্রই দেখেছেন। তারা জানিয়েছেন, কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং টিকার কার্ড প্রদর্শন করে সেবা দেওয়ার বিষয়টি তাদের চোখে পড়েনি।
মোহাম্মদপুর প্রতিনিধি জানান, ধানমন্ডি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁয় স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই। এই এলাকার স্টার কাবাবে খেতে আসা মাহিন জানান, বিধিনিষেধ পরিপূর্ণভাবে মানতে গেলে আমরা হোটেল-রেস্তোরাঁয় এসে খেতে পারব না। ঘরে বসে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে খেতে হবে। মোহাম্মদপুরের বাগদাদ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার বদরুল আলম বলেন, আমরা কাস্টমারকে জিজ্ঞাসা করি টিকা দিয়েছে কি না? অনেকে টিকা দিলেও কেউ টিকার সনদ দেখাতে পারেননি। একই এলাকার ছায়ানীড় হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা যায় ক্রেতাশূন্য। এ রেস্টুরেন্টের মালিক ইব্রাহীম হোসেন বলেন, আমরা অনেকের কাছে টিকার সনদ দেখতে চেয়েছিলাম। তাই আমাদের কাস্টমার কমে গেছে। কেউ কেউ এসে খাবার বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন।
মিরপুর প্রতিনিধি জানান, এই এলাকারও বেশির ভাগ খাবার হোটেল ও রেস্তোরাঁয় টিকার সনদ না দেখেই খাবার বিক্রি করা হচ্ছে।
মহল্লার অলিগলিতে গড়ে ওঠা খাবার হোটেলগুলোয় লোকজন গাদাগাদি করে খাবার খান। বিহারি ক্যাম্পসংলগ্ন বিরানির হোটেলগুলোয় সকাল থেকেই লোকজনের উপচে পড়া ভিড় থাকে। প্রশাসনের নজরদারিও তেমন একটা চোখে পড়ে না। মিরপুর-১-এ কেএফসি, সিক্রেট রেসিপি, পিৎজা হাট ঘুরে দেখা যায়, টিকার সনদ দেখা তো দূরের কথা, মাস্ক ছাড়াই প্রবেশ করছে মানুষ। মিরপুর-১১, ১২ নম্বরে খাবার বিলাস, রাব্বানি হোটেল, ভূতের বাড়ি, ঝাল রেস্টুরেন্ট, কাচ্চি ভাই, উত্তরবঙ্গ খাবার হোটেলের প্রবেশমুখে তাপমাত্রা মাপার মেশিন নিয়ে দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলেও তাপমাত্রা মাপতে দেখা যায়নি। খাবার বিলাস রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার সোহেল বলেন, টিকার সনদ আছে কি না, তা দেখছে দারোয়ান। আমরা শুধু দেখছি মানুষ দূরত্ব বজায় রেখে বসছে কি না। মিরপুর-১ নম্বর প্রিন্স হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে দেখা যায় স্বাস্থবিধির কোনো বালাই নেই। টিকার সনদ দেখতেও দেখা যায়নি।
দক্ষিণখান প্রতিনিধি জানান, উত্তরার সি-শেল রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে বেশ কয়েকজন এখনো টিকা নেননি। রেস্তোরাঁ মালিক আমানুল্লাহ বলেন, কিছু কর্মচারীর টিকা নেওয়া বাকি আছে। বিমানবন্দর মনোলোভা কাবাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের তিন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা এখনো টিকা নেননি।
রেস্তোরাঁয় আসা ক্রেতাদের টিকার কার্ড দেখতেও কর্তৃপক্ষ তাদের কোনো নির্দেশনা দেননি। দক্ষিণখান এলকে প্লাজার লামিয়া ফাস্টফুডের এক কর্মী জানান, তাদের বেশির ভাগ কর্মীই কিশোর। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ টিকার সনদ দেখে সেবা দেওয়ার বিষয়ে তাদের কোনো নির্দেশনা দেননি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজিয়া আফরিন জানান, সোমবার থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকাগুলোয় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করছে।
ডেমরা প্রতিনিধি জানান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৬ থেকে ৭৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার কোনাপাড়া, বাঁশেরপুল, বড়ভাঙ্গা, স্টাফ কোয়ার্টার, বামৈল, বড়ভাঙ্গা, রানীমহল এলাকা, সারুলিয়া বাজার, ডেমরা বাজার, হাজীনগরসহ রাজধানীর ত্রিমহোনী, দক্ষিণগাঁও, নন্দিপাড়া, মুগদা বাসাবো, বনশ্রী, গোড়ান, মালিবাগ ও রামপুরা এলাকার বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত।
এসব এলাকার ছোট হোটেলের মালিক ও কর্মচারীরাও মাস্ক পরিধান করেন না। আর হোটেলে খেতে আসা মানুষজনও মানছেন না স্বাস্থবিধি। টিকার সনদ দেখার বিষয়ে জানতে চাইলে ডেমরার আলমস রেস্তোরাঁর ম্যানেজার মো. বাদশা বলেন, এখানকার বেশির ভাগ কাস্টমার স্থানীয়। আমরা বললেও তারা আমাদের কথা শুনেন না। জোর করে খাবার টেবিলে বসে পড়েন। তাছাড়া মাস্কের কথা বললে তারা কর্মচারীদের ধমক দেন।
দনিয়া প্রতিনিধি জানান, যাত্রাবাড়ী মোড়ে অবস্থিত আরবেন রোস্তোরাঁ চাইনিজ অ্যান্ড পার্টি সেন্টার, গোলাপ শাহ হোটেল, যাত্রাবাড়ী চাইপাই রেস্টুরেন্ট, কোনাপাড়া হোটেল আঙিনা, ফুটপ্লেস রেস্টুরেন্ট, জাফরান রেস্টুরেন্ট, কদমতলীর শনিরআখড়া সূর্যবানু রেস্তোরাঁ, আতিয়া রেস্তোরাঁ ও স্কাই ভিউ রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখা যায়, কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। টিকার সনদও দেখা হচ্ছে না।
যাত্রাবাড়ী মোড়ে অবস্থিত আরবেন রোস্তোরাঁ চাইনিজ অ্যান্ড পার্টি সেন্টারের জিএম আলম ও ম্যানেজার মাসুদুর রহমান বলেন, বিধিনিষেধ ঘোষণার পর রেস্টুরেন্টে লোকজন কম আসছে। তাছাড়া আমরাও জানি না যে কাস্টমারদের কাছে টিকার সনদ চাইতে হবে। ওই রেস্টুরেন্টের ৬/৭ জন কর্মচারীর কাউকেই মাস্ক পরতে দেখা যায়নি।