সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যা মামলার তদন্ত ১০ বছরেও শেষ করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ, গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের (ডিবি) পর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) তদন্তও স্থবির। যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো আলামত পরীক্ষা করে ঘটনাস্থলে দুইজন অজ্ঞাত পুরুষের ডিএনএ পাওয়া গেছে। তবে পাঁচ বছরেও তাদের শনাক্ত করতে পারেনি তদন্ত সংস্থা।
এদিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বারবার আদালত থেকে সময় নেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৮৪ বার সময় নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিনও প্রতিবেদন দিতে পারেনি র্যাব। সময় আবেদন করলে আদালত ২৪ জানুয়ারি পরবর্তী দিন ধার্য করেন। এমতাবস্থায় পরিবারের পাশাপাশি চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
সাগরের মা সালেহা মনির বলেন, আমার ছেলে ও ছেলের বউ কোনো রাজনীতি করত না। তারা দেশদ্রোহীও ছিল না। রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজও করেনি। তারপরও তাদের হত্যার রহস্য কেন উদ্ঘাটন করা হচ্ছে না। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জোর দাবি জানাই।
বর্তমানে র্যাব সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শফিকুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে র্যাব লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, শিগগিরই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের লক্ষ্যে কাজ চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডে সন্দেহজনক হিসাবে যাদের নাম আসছে, তাদের সবার ডিএনএ প্রোফাইল আমরা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছি। কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা ডিএনএ আলামতের সঙ্গে সেখানে পাঠানো কারও ডিএনএ প্রোফাইল এখনো মেলেনি। তাই দুই অজ্ঞাত পুরুষকে এখনো শনাক্ত করা যায়নি।
মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড : ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক গোলাম মোস্তফা সারোয়ার (সাগর সারোয়ার) ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন নাহার রুনা (মেহেরুন রুনী) দম্পতি। ঘটনার পরের দিন রুনীর ভাই নওশের আলম রোমান রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা করেন।
দফায় দফায় তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন : এ মামলার তদন্তকাজ প্রথমে শুরু করেন শেরেবাংলা নগর থানার এসআই মো. জহুরুল ইসলাম। এরপর ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ডিবি উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলম এ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এক রিট পিটিশনে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল মামলার তদন্তভার র্যাবের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়।
পরদিন ১৯ এপ্রিল র্যাব সদর দপ্তরের সিনিয়র পুলিশ সুপার মো. জাফর উল্লাহ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। র্যাবের এ কর্মকর্তা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়ায় ২০১৪ সালের ১২ মার্চ এ মামলার তদন্তভার পান র্যাব সদর দপ্তরের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. ওয়ারেছ আলী মিয়া। নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি এ কর্মকর্তা মামলার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাগর-রুনীর ছেলে মাহির সরোয়ার মেঘকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার জবানবন্দি ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসামি ও সন্দেহভাজনদের ডিএনএ পরীক্ষা করে এনে ওই প্রতিবেদন বিস্তারিত পর্যালোচনা করে তদন্ত করেন। এরপর ২০১৫ সালের মাঝামাঝি র্যাব সদর দপ্তরের সহকারী পরিচালক সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহম্মদ এ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। তিনি মামলার নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ২০১৮ সালের র্যব সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার মো. সহিদার রহমানের হাত ঘুরে বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শফিকুল ইসলাম। তিনি আগের সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে তদন্ত অব্যাহত রেখেছেন।
তদন্তের অগ্রগতি যতটুকু : তদন্তের প্রায় দীর্ঘ ১০ বছর সময়ে র্যাব এ মামলায় আদালতে পাঁচটি তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রথমে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর, এরপর ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, ওই বছরের ৭ জুন, ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর ও সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২১ মার্চ তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্ত অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিটি প্রতিবেদনে প্রায় একই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো আলামতের ডিএনএ পরীক্ষা করে ঘটনাস্থলে দুইজন অজ্ঞাত পুরুষ ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেছে। ওই দুই অজ্ঞাত আসামিকে শনাক্ত করতে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’
এছাড়া আগের চারটি অগ্রগতি প্রতিবেদনের মতো সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনেও বলা হয়, ‘ঘটনাস্থল থেকে চুরি যাওয়া ল্যাপটপ বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে কি না-এ ব্যাপারে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ল্যাপটপ ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সে ব্যাপারে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। চুরি করা ল্যাপটপ কখনো ব্যবহার করা হলে তার তথ্য পাওয়া যেতে পারে। মামলার ভিকটিম মিডিয়াকর্মী হওয়ায় তদন্তকালে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বিভিন্ন আলামত পরীক্ষা, বিদেশি বিশেষজ্ঞদের মতামত, বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ, সমসাময়িক অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিশ্লেষণ, ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী থানাগুলোয় একই অপরাধ প্রক্রিয়ায় সংঘটিত অপরাধ ও অপরাধীদের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। গ্রিল কাটা চোর-ডাকাতদের বিষয়েও নিবিড়ভাবে তদন্ত অব্যাহত আছে।’
২০১৭ সালের পর থেকে অদ্যাবধি আর কোনো তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়নি। ডিএনএ পাওয়া দুই অজ্ঞাত পুরুষের সন্ধান পাওয়া গেছে কি না, সাগর-রুনীর খোয়া যাওয়া ল্যাপটপ ওপেন করে ব্যবহার করা হয়েছে কি না-এ সংক্রান্ত কোনো আপডেট তথ্যও আদালতকে জানানো হয়নি।
আসামিদের অবস্থান : এ মামলায় র্যাব এ পর্যন্ত আট আসামিকে গ্রেফতার করেছে। এরা হলেন-মিন্টু (বারোগিরা মিন্টু), মো. কামরুল ইসলাম হারুন, বকুল মিয়া, রফিকুল ইসলাম, আবু সাঈদ, এনায়েত আহম্মেদ (হুমায়ূন কবীর), পলাশ রুদ্র পাল ও মো. তানভীর রহমান। আসামিদের মধ্যে প্রথম ছয়জন কারাগারে ও পরের দুইজন হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন।