ফি বছর বিশাল বাজেটের লঞ্চ নামছে ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে। নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি আর রঙিন সাজসজ্জায় মনে হতে পারে সেবার মানও এসব মনস্টার লঞ্চে আধুনিক। বাস্তবতায় ঠিক তার উল্টো। সেকেলে ব্যবস্থাই রয়ে গেছে যাত্রীদের জন্য। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য বিআইডব্লিউটিএ আর লঞ্চ মালিক কর্তৃপক্ষ ‘স্বচ্ছতার সাথে’ দায়িত্ব পালনের কথা বললেও কোনোভাবেই যাত্রী হয়রানি থামছে না।
যাত্রীরা বলছেন, নীতিনির্ধারণী দুই পক্ষের স্বচ্ছতার কথা আইওয়াশমাত্র। মালিকপক্ষ যাত্রীদের পণ্য মনে করে হয়রানি, নির্যাতন করে। আর বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ না করায় নৌ-রুটে যাত্রীরা অসহায়। ফলে পন্টুনত্যাগ করার পর কার্যত আইনের বাইরে চলে যায় নৌ-যানগুলো।
সচেতনরা বলছেন, যাত্রীসেবায় লঞ্চ ও সরকারি দফতরের সমন্বয় না থাকায় অরাজকতার সৃষ্টি হচ্ছে। সচেতনতা ও দায়িত্ববোধেই শৃঙ্খলা ফেরাতে পারে এই পথে। দিনে দিনে হয়রানি ও নির্যাতন বাড়ছে।
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বরিশালের পরিবহন পরিদর্শক (টিআই) শামসুদ্দিন খান জানান, বরিশাল-ঢাকা রুটে মোট ২৮টি লঞ্চ যাত্রী পরিবহন করে থাকে। এরমধ্যে বরিশাল-ঢাকা রুটে সরাসরি ১৮টি ও ভায়া ১০টি লঞ্চ চলাচল করে। বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয় সবসময়ে যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।
এমনকি আইনভঙ্গের কারণে ২১টি লঞ্চ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মেরিন আদালতে মামলা চলছে। মামলাগুলো বিআইডব্লিউটিএ থেকে দেওয়া হয়। এছাড়া সচেতনতা চালানো হয়। কিন্তু সুযোগ পেলেই যাত্রী হয়রানি, আইনভঙ্গের কাজ করে থাকে লঞ্চ মালিকরা। নিয়ম মেনে চলার মানসিকতা গড়ে ওঠা দরকার। শুধু মামলা দিয়েই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলেন এই কর্মকর্তা।
জানা গেছে, বরিশাল-ঢাকা নৌরুটে মোট ২২টি লঞ্চ চলাচলের লাইসেন্স রয়েছে। এরমধ্যে ১৮টি লঞ্চ চলাচল করছে। বাকি ৪টি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া যে ২১ লঞ্চের বিরুদ্ধে মামলা চলছে সেইগুলোর মধ্যে এমভি পারাবত ১০ লঞ্চের বিরুদ্ধে ৩টি, এমভি পারাবত ১১ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, এমভি সুন্দরবন ১১ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, এমভি ফারহান ৮ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, এমভি মানামী লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, এমভি কুয়াকাটা ২ লঞ্চের বিরুদ্ধে ২টি, এমভি অ্যাডভেঞ্চর-১ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, এমভি পরাবত ১২ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, এমভি টিপু-১২ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি।
এদিকে বানারীপাড়া-তরুরবাজার রুটের লঞ্চ এমএল রানার বিরুদ্ধে একটি, ঢাকা-ভান্ডারিয়া রুটের এমভি মর্নিং সান লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, এমভি বিউটি অব লইনছরি লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, ঢাকা-চরমোনাই রুটের এমভি কাজল ৭ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি, ঢাকা-বরগুনা ভায়া বরিশাল রুটের এমভি অভিযান ১০ লঞ্চের বিরুদ্ধে একটি মামলা চলমান। এছাড়া যাত্রীবাহী ট্রলার নওরীন, মিরাজ এক্সপ্রেস, আল আরাফাত ও আল্লাহ ভরসার নামে একটি করে মামলা চলছে।
দীর্ঘদিন লঞ্চে চলাচলকারী যাত্রী নিয়াজ ফয়সাল জানান, আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি লঞ্চগুলো ঘাটত্যাগ করার পর দেশের আইনের মধ্যে থাকে না। আইনের ঊর্ধ্বে চলে যায়। যাত্রীরা কেউ আইনের সাহায্য চাইলেও তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ফয়সাল তার জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ৯ জানুয়ারি সকালে সুরভী-৯ লঞ্চে কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ জনকে মারধর করে লঞ্চ স্টাফরা। সেই ঘটনায় আমার বন্ধুকে মারধর করা হয়। আমি মারধর বন্ধ করতে গিয়ে নিজেও হামলার শিকার হই। লঞ্চ স্টাফরা ওই রাতে চেয়েছিল আগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি জানাজানি না হোক। কিন্তু আমার বন্ধু মারুফ আগুনের ছবি তোলে, আরেক বন্ধু ছিল সে ৯৯৯ নম্বরে কল করে। এই কারণে ক্ষুব্ধ ছিল লঞ্চ স্টাফরা। রাতেই মারধরের চেষ্টা করে আমাদের। তবে সবার ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে তা সম্ভব হয়নি। ফলে সকালে সংঘবদ্ধভাবে লঞ্চ স্টাফরা আমাদেরও ওপর হামলা করেন।
আরেক যাত্রী শাহীন বলেন, শুধু সুরভী-৯ লঞ্চে যাত্রী মারধর হয় তেমন কিন্তু নয়; এমন কোনো লঞ্চ নেই যেখানে যাত্রীরা মারধরের শিকার হয়নি বলে মনে হয় না। অনেক যাত্রী মান-সম্মানের ভয়ে কারো কাছে অভিযোগ দেয় না। আবার লঞ্চ স্টাফদের হুমকি-ধমকিতে হয়তো অভিযোগ দেওয়ার সাহসও থাকে না।
শাহীন আরও বলেন, শুনেছি মামলা হয়েছে। কিন্তু মামলা দিলেই এসবের সমস্যার সমাধান সম্ভব না। আইনের ব্যবস্থা যতই বলা হচ্ছে, আদতে যাত্রী হয়রানিতো কমছে না। মূলত লঞ্চে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগ করা জরুরি। নয়তো লঞ্চ কর্তৃপক্ষের হয়রানি, লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে সব উদ্যোগই অকার্যকর।
সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশাল জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, ঢাকা-বরিশাল রুটে একের পর এক দুর্ঘটনা তো ঘটেই চলছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য শুধু একটি পক্ষকে কাজ করলে চলবে না। সমন্বিতভাবে সকলের কাজ করতে হবে। তাছাড়া যাত্রীদের নিরাপত্তা না দিলে একসময়ে লঞ্চ পরিবহন থেকে যাত্রীরা মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে।
তিনি বলেন, নৌ-রুট নিরাপদ রাখতে কেন এতো মামলা দিতে হবে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের? কেন মালিকপক্ষ সচেতন হবে না। মনে রাখতে হবে, যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন লঞ্চ মালিকরাই।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু অবশ্য যাত্রী হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, লঞ্চে যাত্রী হয়রানি করার প্রশ্নই ওঠে না। সম্প্রতি একটি লঞ্চে যাত্রী ও সাংবাদিকদের ওপর যে হামলার ঘটনা ঘটেছে তা ন্যাক্কারজনক। আমি ওই ঘটনার নিন্দা জানাই। আমরা যারা ব্যবসা করি তারা যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করি। আমারা সব সময় স্বচ্ছ থাকার চেষ্টা করি। এছাড়া যে সব মামালা লঞ্চে দেওয়া হয়েছে সেগুলো মেরিন কোর্টে বিচারাধীন আছে।
বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক ও বরিশালের নৌবন্দর কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নৌ-পথে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছি। কোনো নৌযানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে মামালা দেওয়াসহ তাৎক্ষণিক যে ব্যবস্থা প্রয়োজন তা গ্রহণ করি। আমরা চাই নৌপথে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক।