কক্সবাজার হোটেল-মোটেল জোনের ‘অঘোষিত জমিদার’ এখন মহিউদ্দিন। বাবা দিনমজুর বা মা গৃহকর্মীর কাজ করলেও এই মহিউদ্দিনের কব্জায় এখন পর্যটন নগরী কক্সবাজারের শতাধিক ফ্ল্যাট। এসব ফ্ল্যাট আবাসিক হোটেল হিসাবে ব্যবহার করা হলেও তার আয়ের নেপথ্যে অন্য কোনো কিছু আছে কিনা তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। তার এ গায়েবি আয়ের উৎস নিয়ে নানা কথা বাজারে চালু আছে। অনেকে আবার মরণনেশা ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেছেন।
চার বছর আগেও তিনি আবাসিক হোটেলে পিয়নের চাকরি করতেন। আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতোই ২০১৮ সাল থেকে তার ফুলফেঁপে ওঠা শুরু হয়। বিভিন্নজনের কাছে তিনি ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাগ্নে’ হিসাবে পরিচয় দিয়ে তিনি দামি গাড়িতে চড়ে প্রায়ই ঢাকায় যাতায়াতের খবরও পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় একজন কাউন্সিলরের সঙ্গে তার যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। মহিউদ্দিন নিজেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক চুক্তিভিত্তিক নেওয়া ৩০টি ফ্ল্যাট বিদেশি এনজিওকর্মীদের কাছে ভাড়া দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।
মহিউদ্দিনের হঠাৎ উত্থান নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনও কাজ শুরু করেছে। কথা হয় কক্সবাজার হোটেল-মোটেল জোনের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তারা বলছেন, করোনাকালে আমাদের যেখানে বড় অঙ্কের টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। অনেকে এ ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ মহিউদ্দিনের চিত্র ছিল উলটো। তিনি দ্বিগুণ জামানত ও চড়া ভাড়ায় আমার দেখা অন্তত ৩০-৪০টি ফ্ল্যাট নিজের কব্জায় নিয়েছেন। এটা তো রীতিমতো বিস্ময়কর বিষয়। তার গায়েবি আয়ের উৎস তদন্তের দাবি করছি। তবে অনেকেই মহিউদ্দিন ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেন।
কথা হয় অভিযুক্ত মহিউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আর্থিক অনটনের কারণে আমি ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন হোটেলে চাকরি করেছি। কিন্তু মানুষের কি টাকা-পয়সা হতে পারে না? আমারও তাই হয়েছে। আমি তো বিদেশিদের ৩০টি ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছি। একটি ফ্ল্যাট গড়ে ৫০ হাজার করে আসে। এসব ফ্ল্যাট নিতে প্রাথমিক বিনিয়োগ হিসাবে লাখ লাখ টাকা লেগেছে। এসব টাকা কোথায় পেয়েছেন? এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন।
নিজেকে ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাগ্নে’ পরিচয় দেওয়ার কথা জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করেন। অস্বীকার করেছেন ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টিও। এত ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করার জন্যও তো বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের বিষয় জড়িত, পেলেন কোথায় জানতে চাইলে তিনি এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে ঢাকার একজন সিনিয়র সাংবাদিককে দিয়ে এ সংক্রান্ত নিউজ না করার জন্য অনুরোধ করা হয় এ প্রতিবেদককে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে কক্সবাজার হোটেল-মোটেল জোনে মহিউদ্দিনের প্রায় শতাধিক বাণিজ্যিক ফ্ল্যাট রয়েছে। এসব ফ্ল্যাট পরিচালনায় অন্তত ৬ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করার তথ্য পাওয়া গেছে। অনেকে বলছেন, নামে-বেনামে মহিউদ্দিনের আরও অনেকে সম্পদ রয়েছে। কক্সবাজারের কলাতলী হোটেল-মোটেল জোনে গণপূর্ত ১নং ভবনে ১০টি, গণপূর্ত ২নং ভবনে ২৭টি, গণপূর্ত ৫নং ভবনে ৪টি, গণপূর্ত ৯নং ভবনে ৫টি, হোটেল সি পার্লে ৩টি, হাইপেরিয়ান সি ওয়েভ হোটেলে ১৮টিসহ ৬৭টি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন ৩০টি ছাড়াও আরও একাধিক বিলাসবহুল ভবন তার কব্জায় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্তত ৫টি ফ্ল্যাট তার ক্রয় করা বলে জানা গেছে। একটি সূত্র জানান, এর মধ্যে তিনি ১০- ২০ লাখ টাকায় অন্তত ২০টি ফ্ল্যাট বন্ধক নিয়েছেন। এসব ফ্ল্যাটের আর ভাড়া দিতে হয় না। বাকিগুলো তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অগ্রিম দিয়ে মাসিক ১৫-২০ হাজার টাকায় ভাড়ায় নিয়েছেন।
মহিউদ্দিনের বাড়ি মহেশখালীর শাপলাপুর ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক জানান, মহিউদ্দিন রাতারাতি কোটিপতি হয়ে গেলেও তার বাবা আবদুর রাজ্জাক এখনো দিনমজুরের কাজ করেন ও মা শাহেনা বেগম দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত নজরুল ইসলামের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করছেন।
মহেশখালীতেও কোটি টাকা মূল্যের কয়েকটি জায়গা ক্রয় করেছেন উল্লেখ করলেও তার উত্থান নিয়ে তার অজ্ঞতার কথা জানান এ প্রতিবেদককে। তবে মহিউদ্দিনের বাবা ও মায়ের সঙ্গে চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর একজন কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি কক্সবাজার হোটেল-মোটেল জোনের যে কয়েকজনের আয়ের উৎসের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে তাদের মধ্যে মহিউদ্দিনের নামও রয়েছে। আয়কর অফিসে তার কোনো ফাইল আছে কিনা তা যাচাই করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, খোঁজ নিয়ে যদি মহিউদ্দিনের মাদক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।