পানিতে ডুবে চট্রগ্রাম জেলায় মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে। ২০২১ সালের পহেলা জানুয়ারি হতে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত- এ জেলায় অন্তত ৫৭ জন পানিতে ডুবে মারা যায়।
নিহতদের ৪৭ জনের বয়স নয় বছরের কম। পারিবারিক সদস্যদের অগোচরে এসব শিশুরা পানির সংস্পর্শে গিয়ে মৃত্যু বরণ করে। নিহতদের মধ্যে ১৩ কন্যা শিশু এবং ৩৪ ছেলে শিশু।
চট্রগ্রাম ছাড়া এ সময়ে আরো ১৩টি জেলায় অন্তত ৩০ জন বা তার বেশি সংখ্যাক মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে নারায়নগঞ্জ ৫২ জন, ব্রাক্ষ্মণবারিয়া ৫১ জন, কক্সবাজারে ও ময়মনসিংহে ৪৮ জন, নোয়াখালীতে ৪১ জন এবং চাঁদপুরে ৩৯ জন করে মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। অন্যদিকে শরিয়তপুর জেলায় পানিতে ডুবে সবচেয়ে কম মানুষের মৃত্যু ঘটে। গত ১০ মাসে এ জেলায় চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
কম মৃত্যুর দিক থেকে নড়াইল, মাগুরা, বান্দরবান, রাজবাড়ী ও খুলনা জেলাগুলো রয়েছে। এসব জেলায় উল্লেখিত ১০ মাসে মৃত্যু ছিল ২ থেকে ৫ জনের মধ্যে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে এরকম চিত্র দেখা গেছে। গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান সমষ্টি ২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রবণতা বিশ্লেষণ করে আসছে।
সমষ্টি’র বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, গত ১০ মাসে (এ বছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত) ৯১৭টি ঘটনায় ১ হাজার ২৪৯ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। এর মধ্যে ১ হাজার ১২২ জন পানিতে ডুবে এবং ১২৭ জন নৌযান দুর্ঘটনায় ডুবে বা আহত হয়ে মারা যায়। পানিতে ডুবে মৃতদের ৮৪ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের কম। চার বছর বা কম বয়সীদের মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু সবচয়ে বেশি, ৫৩৮ জন। ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী ৩৬৪ জন, ১০-১৪ বছরের ১০৩ জন এবং ১৫-১৮ বছরের ৩৯ জন। ২০৫ জনের বয়স ছিল ১৮ বছরের বেশি।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে পানিতে ডোবার ৭৯ শতাংশ ঘটনা ঘটে দিনের বেলায়। দিনের বেলায় শিশুরা পানির সংস্পর্শে বেশি যায়। দিনের প্রথম ভাগে অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ৫০৬ জন এবং দুপুর থেকে সন্ধ্যার আগে ৪৫৪ জন মারা যায়। তবে রাতেও পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সন্ধ্যা বা রাতে ২৮৯ জনের মৃত্যু হয়।
বর্ষাকাল ও এর আগে-পরের মাসগুলোতে (জুন-অক্টোবর) পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০২১ সালে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২১০ জন মারা যায় আগস্ট মাসে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল জুলাই মাসে ১৫৭ জন। তবে এপ্রিল হতে অক্টোবর পর্যন্তÍ শতাধিক করে মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
পরিবারের সদস্যদের যথাযথ নজরাদারি না থাকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পানিতে ডোবার ঘটনা ঘটে। পানিতে ডুবে ১ হাজার ২৪৯টি মৃত্যুর প্রায় ৯০ শতাংশ (১,১৩১) ঘটে পরিবারের অন্য সদস্যদের অগোচরে। অধিকাংশ শিশু বড়দের অগোচরে বাড়ি সংলগ্ন পুকুর বা অন্য জলাশয়ে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়।
একই পরিবারের একাধিক সদস্য পানিতে ডুবে মারা গেছে। গত ১০ মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়Ñ ৮৩টি পরিবারের ১৬৬ জন সদস্য পানিতে ডুবে মারা যায়। যাদের মধ্যে শিশুর সঙ্গে ভাই অথবা বোনসহ ১৪৪ জন, বাবা-মাসহ ৮ জন, দাদা-দাদি বা নানা-নানিসহ ৪ জন, চাচা-খালাসহ ১০ জন মারা যায়। উৎসব বা অন্য কোনো সময়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে একই পরিবারের বেশিরভাগ শিশু মারা যায়।
সমষ্টি’র গবেষণায় দেখা যায়, গত ১০ মাসে নৌযান দুর্ঘটনা বাদে পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম বিভাগে, ৩১৬ জন। এছাড়া ঢাকায় ২৪০ জন, রাজশাহীতে ১৫৮, ময়মনসিংহে ১৩০, বরিশালে ১২৪, রংপুরে ১০৮, খুলনা বিভাগে ১০৪ জন মারা যায়। এ সময়ে সবচেয়ে কম মৃত্যু ছিল সিলেট বিভাগে, ৬৯ জন।
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর বিষয়টি একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে অধিকতর গুরুত্বারোপ করেছে। সরকার ও দাতা সংস্থার যৌথ উদ্যোগে পাইলট ভিত্তিতে কয়েকটি জেলায় কিছু কিছু কাজ হচ্ছে। শিশু সুরক্ষার জন্য দেশব্যাপী এসব কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ বিষয়ে ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিপিপিটি একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাগুলোর জাতীয়ভাবে কার্যকর তথ্যায়ন ব্যবস্থা না থাকায় বেশির ভাগ ঘটনাই গণমাধ্যমে উঠে আসে না। ফলে এ সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায় না। পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে জাতীয়ভাবে সর্বশেষ জরিপটি হয়েছে ২০১৬ সালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং ইউনিসেফ এর সহযোগিতায় সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ পরিচালিত ওই জরিপে তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী প্রতিবছর সব বয়সী প্রায় ১৯ হাজার মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এদের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি অর্থাৎ আনুমানিক ১৪ হাজার ৫০০ জনই ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের শিশুরা পানিতে ডুবে প্রাণ হারায়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা প্রতিদিন প্রায় ৩০ জন, অর্থাৎ বছরে প্রায় ১০ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর ৪৩ শতাংশের কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া।