স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাড়ছে সহিংস ঘটনা। প্রতিদিনই রক্তাক্ত হচ্ছে নির্বাচনের মাঠ। এ বছর শুধু ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরেই প্রায় ২০০ সংঘাতের ঘটনায় ৪৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন অসংখ্য। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে প্রার্থীদের নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনেরও নানা অভিযোগ উঠছে।
এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচন ও ভোট কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, নির্বাচন ঘিরে এ সংঘাত, বিশৃঙ্খলা ও হতাহতের দায় ইসি, সরকার ও দল হিসাবে আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে। কারণ আইন ও বিধিমালায় নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া আছে। পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্টরাও (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) এসব ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এতে সংঘাত বেড়েই চলেছে।
এছাড়া নির্বাচনি মাঠে দলীয়ভাবে বিএনপি না থাকায় অধিকাংশ স্থানেই রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের বিদ্রোহী প্রার্থী। তারা নিজেরাই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। আওয়ামী লীগ তাদের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ধরে রাখতে পারছে না। এজন্য দায় এড়াতে পারে না দলটি।
জানা গেছে, দ্বিতীয় ধাপে দেশের ৮৪৬টি ইউপিতে ভোট হবে ১১ নভেম্বর। এছাড়াও তৃতীয় ধাপের ১০০৭ ইউপিতে ভোট হবে ২৮ নভেম্বর। এই নিবাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। ঘটছে হতাহতের ঘটনাও।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী-চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু ইউপি নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১৬৭টি। এতে ৩০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে ১৯৪২ জন। স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচনগুলো ধরলে এ সংখ্যা আরও বেশি।
এদিকে নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে সংঘর্ষের ঘটনাও ততই বাড়ছে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের ৪ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনি সহিংসতায় অন্তত ১৬ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতার ঘটনাগুলো ঘটছে তার দায় নির্বাচন কমিশনের। তারা কোনোভাবেই এ দায় এড়াতে পারে না। নির্বাচন কমিশন এসব ঘটনা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এর আগেও যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল সে সময়ও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারণে এখনো তারা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া আছে। কিন্তু তারা এর প্রয়োগ করতে পারেনি। তারা আসলে ভয় পায়। নির্বাচনি সহিংসতা বন্ধে করণীয় কি-তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে নির্বাচনগুলোতে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিন্ড’ নিশ্চিত করতে হবে। প্রার্থী ও ভোটারদের নিরাপত্তা দিতে হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সেই সদিচ্ছা আছে কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কিছুটা উত্তেজনা থাকে, সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু সহিংসতা যে পর্যায়ে চলে গেছে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সহিংসতা বাড়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সহিংসতা বাড়ার প্রধানত দুটি কারণ। একটি হচ্ছে-যারা চেয়ারম্যান বা মেম্বর পদে নির্বাচন করছেন, তাদের বেশিরভাগই জনসভার লক্ষ্য থেকে দূরে সরে গেছেন। তাদের লক্ষ্য হয়ে গেছে-যে কোনোভাবে নির্বাচনে জিততে হবে এবং জিতে ক্ষমতাবান হয়ে নানা কিছু করবেন, এলাকায় ক্ষমতার দাপট দেখাবেন। জনসেবার লক্ষ্য থেকে সরে যাওয়া ও লোভ-লালসার কারণেই যে কোনো প্রক্রিয়ায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা করেও নির্বাচনে তারা জয়ী হতে চান।
নির্বাচনি সহিংসতায় দায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের অবশ্যই দায় আছে। এবার যেহেতু বিএনপি অংশ নিচ্ছে না তাই তাদের সেভাবে দায়ী করা যাচ্ছে না। কিন্তু নিজ দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে না পারার দায় আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। অন্যদিকে যে কোনো নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে সহযোগিতা করার দায়িত্ব সরকারের। সরকারেও আওয়ামী লীগ আছে সুতরাং এখানেও তারা দায় এড়াতে পারবে না। এর বাইরে নির্বাচন কমিশনেরও দায় আছে। আমাদের নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সার্বভৌম কমিশন। নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান, আইন ও বিধিবিধান অনেকভাবে ক্ষমতায়ন করেছে। কিন্তু অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা-তারা তা নিতে পারছে না। এখানে তারা ব্যর্থ। মোদ্দা কথা হলো-এ সংঘাত, বিশৃঙ্খলা ও প্রাণহানির দায় নির্বাচন কমিশন সরকার ও দল হিসাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনে আমরা যে সহিংসতাগুলো দেখছি, এটা কিন্তু রোগ নয়, রোগের উপসর্গ। রোগের কারণ খুঁজলে দেখা যাবে, রোগটা আছে সরকারের মধ্যে, নির্বাচন কমিশনের মধ্যে ও প্রার্থীদের মানসিকতার মধ্যে।
তিনি বলেন, রাজনীতি হওয়া উচিত মানুষের কল্যাণে। কিন্তু এখন রাজনীতি জনগণের স্বার্থে নয়, দল ও ব্যক্তির স্বার্থে করা হয়। এটাকে বলে ফায়দাভিত্তিক রাজনীতি। এ কারণে তারা সহিংসতা করতে দ্বিধা করে না। কারণ এখানে স্বার্থ জড়িত। আরেকটা কারণ হচ্ছে দলভিত্তিক নির্বাচন।
নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, দেশে নির্বাচন কমিশন নামে একটা প্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। কেউ আচরণ বিধি লঙ্ঘন করলে বা সহিংসতা করলে তাদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা নিত তাহলে এগুলো ঘটত না। অন্যায় করে পার পেয়ে গেলে সেটাতে আরও উৎসাহিত হয়।
সহিংসতার ঘটনা কিভাবে কমানো যায় জানতে চাইলে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের রাজনীতিবিদদের ফায়দা ভিত্তিক রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। দলীয় ভিত্তিক নির্বাচন থেকে সরে আসতে হবে। এছাড়া নির্বাচনি ব্যবস্থাকে আরও সুসংহত করতে হবে।