সম্প্রতি ভারতীয় ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম ‘হইচই’-এ মুক্তি পেয়েছে ওয়েব সিরিজ ‘তাকদির।’ বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটের ওপর নির্মিত এই ওয়েব সিরিজ নিয়ে সোশ্যাল সাইটগুলোতে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে বেশ কদিন ধরেই। অনেকেই বলছেন, দুর্দান্ত হয়েছে। অনেকেই বলছেন, অনেক দিন পর ভালো একটি কাজ হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, এত অসংলগ্ন গল্প নিয়ে এত আলোচনা কিসের?
নেটিজেনদের মতে, চঞ্চল চৌধুরীসহ বাংলাদেশের সব শিল্পী দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। তাকদির সৈয়দ আহমেদ শাওকী পরিচালিত বাংলা ওয়েব সিরিজ। হইচই পঁচিশটি ওয়েব সিরিজের ঘোষণা দেয়, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকেন্দ্রিক তাকদির অন্যতম। মূলত সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া একজন নারী সাংবাদিকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এই সিরিজের গল্প আবর্তিত হয়েছে।
এতে প্রধান চরিত্রে রয়েছেন চঞ্চল চৌধুরী, মনোজ কুমার প্রামাণিক, সানজিদা প্রীতি, পার্থ বড়ুয়া ও সোহেল মণ্ডল। বিশেষ করে চঞ্চলের সঙ্গে সোহেল মণ্ডলের যে রসায়ন ফুটে উঠেছে, তা জীবন্ত ও মুগ্ধকর- অন্তত নেটিজেনদের তা-ই মত। কিন্তু গল্পের অসংলগ্নের প্রসঙ্গটাই উঠে আসছে বারবার। বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মীরা বলছেন, তাকদির সিরিজে পত্রিকা অফিসের যে যে প্রচলিত নিয়ম দেখানো হয়েছে তা পুরোটাই অসলংগ্ন। এমনটা পত্রিকা অফিসে হয় না।
একজন সিনিয়র গণমাধ্যমকর্মী নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তাকদির দেখলাম, অভিনয় আর মেকিং ছাড়া বাকি সবটাই এত অযৌক্তিক! সময় নষ্ট করে লাভের লাভ একটাই হলো। জানতে পারলাম, এ দেশে মিডিয়ার কাজের ধরন বা একজন যুক্তিবাদী হাইপ্রোফাইল সাংবাদিকের বিবেচনার জায়গা বা বড় পত্রিকার কর্মপদ্ধতি- এসব নিয়ে কাহিনিকারদের আরো স্টাডি করা দরকার । মিডিয়ার গল্প নিয়ে বিশাল রিভিউ লেখা যেত, কিন্তু মনে হচ্ছে সর্ব-অঙ্গে ব্যথা ওষুধ দিব কোথা!’
অর্থাৎ এই ওয়েব সিরিজের সর্বাঙ্গেই ব্যথা রয়েছে। যেগুলো ধাপে ধাপে খণ্ডন করা যায়। যা-ই হোক, আরেকজন গণমাধ্যমকর্মী লিখেছেন, ‘সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া একজন হাইপ্রোফাইল সাংবাদিককে মেরে ফেলা হলো; সঙ্গে গুম করা হলো তার সঙ্গী আরেক ফটো সাংবাদিককেও! অথচ আপনারা শুধু একজন সাংবাদিকের ছবি ছেপে পত্রিকায় আট কলামে লাল রঙে শিরোনাম করে দিলেন। ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর স্ট্যাটাস, সংখ্যালঘুদের ঘর-বাড়িতে আগুন, ভিটাবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, গণধর্ষণ, ভাইরাল করা হলো ভিডিও! অথচ আপনারা অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে ভিকটিমের ছবি ছেপে দিলেন পত্রিকায়।’
অনেকের মতেই ১৫ থেকে ১৮ মিনিটে শেষ হয়ে যাওয়া গল্পটাকে অনর্থক ঘোরানো হয়েছে। দর্শকরা হয়তো সাসপেন্সের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু তাদের দেওয়া হলো একটি ‘ফাঁপা’ গল্প। মৌসুমী নামের একজনের বক্তব্য, একজন ধর্ষিতা ও একজন প্রভাবশালীর সাক্ষাৎকার নিয়ে ফেরার সময় নারী সাংবাদিককে ফেরিতে গুলি করে মেরে ফেলা হলো, সঙ্গে ছিল তরুণ সহকর্মী ফটো সাংবাদিক। যে ফটো সাংবাদিক লাশ নিয়ে এত ঘটনা ঘটালেন শেষদিকে সে নির্বিকার হয়ে গেল, তার কোনো ভূমিকাই নেই। কেন? তার ওপর অনেক দর্শকের ফোকাস ছিল, অথচ কাহিনিকার তাকে নিয়ে আর লিখতে না পেরে গল্পের আগামাথা হারিয়ে ফেললেন।’
গল্পটা খটকা লেগেছে আরো অনেকের কাছেই, যারা বিভিন্ন আলোচনায় বা ফেসবুকে লিখে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, নারী সহকর্মীকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে মারল। সেই লাশ ফেরির একটা লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্সে ওঠানো হলো, এই দৃশ্য তো সহজ নয়। আর সহকর্মীর কাজ তো সেটা নয়। একজন সাংবাদিকের পালিয়ে যাওয়া দেখানো হয়েছে ওই অঞ্চলের প্রভাবশালী সায়মনের কারণে। এত ফটো সাংবাদিক ফেরিতে হৈচৈ শুরু করলেও ওই মৃত্যুর একটা কিনারা হতো। গল্প সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু ফ্রিজিং ভ্যানে লাশ চলে গেল ঢাকায়। সেই ফটো সাংবাদিক যে উদ্দেশ্যে নারী সাংবাদিকের লাশ ভ্যানে উঠিয়েছিল, তা তো ঢাকা গেলেই সম্পন্ন হওয়ার কথা। সেই লাশ বরিশাল গেল, আবার গেল শরীয়তপুর- এসব একেবারে বেখাপ্পা। আর একটা ভ্যানে যখন একটি পরিবারের মৃতদেহ ওঠানো হয়, তখন ওই ভ্যানে পাশেই একটি লাশ আছে, সেটা বোঝা যাবে না? অন্য একটি লাশের সঙ্গে বদলে ফেলে বরিশালে দাফন করা হয় ওই সাংবাদিক নারীর লাশ। ওখানকার স্বজনরা কি একবারও তাদের মৃত স্বজনের মুখ দেখবে না? যদিও লাশের অবস্থা খারাপ বলে একটা সংলাপ দেওয়া হয়েছিল।
নেটিজেনদের একাংশ বলছে, মেমরি কার্ড নিয়ে এমন অনেক গল্পে নাটক-সিনেমা হয়েছে। একটি পত্রিকার ফটোগ্রাফার লাশটিকে ঢাকার পুলিশের কাছে হস্তান্তর না করে সে ফেরিঘাট থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে বরিশাল, শরীয়তপুর- এসব করে বেড়াল, এর অর্থ কী? সে লাশের পেট থেকে মেমরি কার্ড বের করে বাঁচতে চাইছিল, এ জন্য তারা শরীয়তপুরে একজন ডোমকে নিয়ে এসে পেট কাটায়- এসব খুবই দুর্বল। মনোজ প্রামাণিককে সাংবাদিকের যে চরিত্রে দেখানো হয়েছে, সাধারণ মানুষের কাছে সহজ মনে হলেও সেটা আসলে বেমানান। ঢাকার প্রধান অফিসে কর্মরত একজন ইয়াং ডাইনামিক জার্নালিস্ট এত বোকা হতে পারে না। আর সংবাদ সংগ্রহের যে পদ্ধতি তা পুরোটাই পত্রিকা অফিসের নিয়মের বাইরে ছিল।
শরীয়তপুর থেকে লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানে মাছ নিয়ে আসছিল তাকদির। হুট করেই সেই ভ্যানে একটি লাশের সন্ধান মিলল। শরীয়তপুর থেকে ঢাকা- এই দীর্ঘ পথে হুট করে লাশ দেখানো হলো। আর যে সাংবাদিককে দেখানো হলো দ্বিধাগ্রস্ত, সে কি না তালাবদ্ধ লাশবাহী ফ্রিজিং ভ্যানের তালা খুলে তার ভেতর নারী সহকর্মীর লাশ ঢুকিয়ে ফেলল? ঢাকা থেকে তাকদির যখন বরিশালে যাচ্ছিল তখন সে মন্টুকে ডাকে, ঢাকার অদূরে পূর্বাচলের কাছে শরীয়তপুর থেকে মন্টু কি উড়ে এলো?
তবে এসব সমালোচনা ছাপিয়ে সাধারণ দর্শকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে তাকদির। চঞ্চল চৌধুরী, সোহেল মণ্ডল, মনোজ, পার্থ বড়ুয়া, সানজিদা প্রীতি, মীর রাব্বী- তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গায় শতভাগ অভিনয়দক্ষতা দেখিয়েছেন। আর এটাই এই ওয়েব সিরিজের মূল শক্তি, গল্প নয়- এমনটাই মনে করছেন নেটিজেনরা।
চঞ্চলের কথা টেনে নেটিজেনরা বলছেন, ‘বলিউডের যদি একজন নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী থাকে, তাহলে আমাদের আছে একজন চঞ্চল চোধুরী।’
সোহেল মণ্ডলকে নিয়ে আবিদা রুচি লিখেছেন, যার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছি, তিনি হচ্ছেন মন্টু চরিত্রটি। ‘পঞ্চায়েত’ সিরিজে এ রকম একটা দুর্দান্ত সাইড ক্যারেক্টার দেখেছিলাম। আমার কাছে অভিনয় মানে নায়ক, নায়িকা বা সারাক্ষণ পর্দায় থাকা নয়, তুমি ৫ মিনিটের জন্য স্ক্রিনে এলেও দেখিয়ে দিতে যদি সক্ষম হও, তুমি কী জিনিস, তাহলেই শুধু তুমি একজন আর্টিস্ট। তাকদির দেখে উপলব্ধি হলো, ‘বাংলাদেশ একজন জেনুইন আর্টিস্ট পেল।’
তাকদির নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না কেন- এ নিয়ে সামান্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শবনম ফারিয়া। ইনস্টাগ্রামে লাইভে এসে বলেন, ‘এটা খুবই ভালো একটা কাজ, এটা নিয়ে আরো আলোচনা হওয়া দরকার। আমি একজন অভিনয়শিল্পী, আমি জানি এটা অনেক ভালো হয়েছে, এটা নিয়ে বেশি বেশি কথা হওয়া উচিত।’