পঞ্চাশোর্ধ্ব কৃষক রবিউল হকের জীবন কেটেছে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের সারিকাইত ইউনিয়নে। বর্ষার অমাবস্যা-পূর্ণিমা ভয়ের কারণ হয়ে আসে তাঁর কাছে। ঘূর্ণিঝড় হলে তো রীতিমতো আতঙ্কে ভুগতে থাকেন। কেননা, সমুদ্রের জোয়ারে বাঁধ ভেঙে তাঁর ছোট বসতঘর তলিয়ে গেছে অনেকবার।
ভাঙা বাঁধের কারণে বারবার এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার হতাশা ও আক্ষেপের কথা অকপটে বলেন রবিউল। তিনি বলেন, ‘বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানিতে গ্রাম তলিয়ে যায়। তখন গরু-ছাগল উঁচু জায়গায় রেখে আসি। আর আমরা পানিবন্দী হয়ে না খেয়ে থাকি। পানি নেমে গেলে শুরু হয় ঘর গোছানোর কষ্ট। এরপর আবার পানি ঢোকে, পানি নামে—কিন্তু দুর্ভোগ কমে না।’
ভাঙা বাঁধের কষ্ট শুধু সন্দ্বীপের নয়, কষ্টে আছেন চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলা বাঁশখালী ও কক্সবাজারের বিপুলসংখ্যক বাসিন্দা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, এখানে মোট বাঁধ রয়েছে ৮৩৪ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২১৪ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। কক্সবাজারের ১১৭ কিলোমিটার, বাঁশখালীর ৮০ কিলোমিটার ও সন্দ্বীপের ১৭ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। মূলত এসব বাঁধ উপচে প্লাবিত হয় গ্রাম। ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে।
সবশেষ গত ২৩ জুলাই লঘুচাপ ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার ৫ ইউনিয়নের ১৬টি গ্রামের ৬ শতাধিক ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। কুতুবদিয়া দ্বীপের চতুর্দিকে পাউবোর বেড়িবাঁধ আছে ৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৭ কিলোমিটার একেবারেই ভাঙা। অন্যদিকে বাঁশখালীর জলকদর খাল ও সমুদ্রের পাশের বাঁধ নিয়ে ভোগান্তিতে আছে গ্রামবাসী। এ উপজেলার প্রায় ৬৫ কিলোমিটার বাঁধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে খোদ পাউবো।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, জোয়ারের পানির উচ্চতা আগের চেয়ে বেড়েছে। সরকারের পরিকল্পনায় ঘাটতি আছে। ফলে স্বাভাবিক সময়েই পুরোনো, জীর্ণ, ভাঙাচোরা বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ছে, গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে।
পাউবো বান্দরবানের নির্বাহী প্রকৌশলী (কুতুবদিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত) অরূপ চক্রবর্তী বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও আম্পানে কুতুবদিয়ার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরপর থেকে টানা বৃষ্টি পড়ছে। তাই বাঁধের মেরামতকাজ ঠিকভাবে করা যায়নি। এখন বৃষ্টি বন্ধ হলে কাজ শুরু হবে।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতি বাড়ে
সবশেষ দুটি ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামে ক্ষয়ক্ষতি কম নয়। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে চট্টগ্রাম জেলায় দুর্যোগের কবলে পড়ে ২৭টি ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষ। ৩৬৫টি বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়ে যায়। সরকারি হিসাবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ক্ষতি ১৭ কোটি টাকা।
জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ৬৬ কিলোমিটার পাকা সড়ক সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। এ ছাড়া ৩০টি কালভার্ট নষ্ট হয়েছে। ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজার জেলার ২৩টি এলাকা ও কুতুবদিয়া উপজেলার কয়েক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।
পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের অনেকটাই ঠিক করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে উপকূলের মানুষের জীবনযাত্রা ও দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ করছে নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বাংলাদেশ।
মানুষের দুর্ভোগের বিষয়ে সংস্থার গবেষক মুহাম্মদ ফররুখ রহমান বলেন, দশকের পর দশক ধরে উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলো অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে উপকূলীয় জনপদ রক্ষায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা দরকার।
বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প
সন্দ্বীপের প্লাবন ঠেকাতে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে পাউবো। এ প্রকল্পের ফলে সন্দ্বীপে ১৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে।
পাউবো সূত্র জানায়, কক্সবাজার সদরে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ১৫ কিলোমিটার, চকরিয়ায় ৬৪ কিলোমিটার, মহেশখালীতে সাড়ে ১৮ কিলোমিটার, কুতুবদিয়াতে ২০ কিলোমিটার। এ ছাড়া চকরিয়ার ৫টি এলাকায় ২৫০ মিটার বাঁধ একেবারে ভেঙে গেছে।
কুতুবদিয়ায় বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। ৪৪ কিলোমিটারের এ বাঁধের উচ্চতা থাকবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯ মিটার, চওড়ায় ৭ মিটার। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রাথমিকভাবে আড়াই হাজার কোটি টাকা।
চকরিয়ায় ৬৪ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ সংস্কারের জন্য ৯০৮ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে সাড়ে ১৮ কিলোমিটার সমুদ্র উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। চার হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল দীর্ঘদিন ধরে বাঁধ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, পলি ও জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। লবণ তৈরিতে বাঁধ কেটে পানি ঢোকানো হয়। এর কারণে বেড়িবাঁধ দুর্বল হয়ে যায়। এ ছাড়া পাউবো শক্ত ও টেকসই বেড়িবাঁধ তৈরি ও সংস্কার করতে পারছে না। ফলে সহজেই বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।