বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের ছোপখালী গ্রামের কৃষক হারুন অর রশিদ। তার ৯ বছরের মেয়ে পুতুল গত ৪ দিন ধরে পেটের পীড়ায় ভুগছেন। তাকে ইউনিয়নের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে কোনো চিকিৎসক নেই।
বাধ্য হয়ে পুতুলকে নিয়ে বেতাগী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছুটতে হয়েছে হারুন অর রশিদকে। তবে সেখানেও পরীক্ষা নিরীক্ষার কিছু না পেয়ে ছুটেছেন ৫০ কিলোমিটার দুরে বরিশাল শহরে। পরে বরিশাল নগরীর একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দেখিয়েছেন হারুন অর রশিদ।
শুধু হারুন অর রশিদ নন, এমন অনেক হারুনকে চিকিৎসার জন্য ছুটতে হচ্ছে শহরে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকার পরও সেবা পাচ্ছে না রোগীরা।
এ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে শুধু কাউনিয়া ইউনিয়নে একজন চিকিৎসক রয়েছেন। তবে ওই চিকিৎসককেও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. চিন মং জানান, তার উপজেলার ৭ ইউনিয়নের মধ্যে একটি ইউনিয়নে চিকিৎসক রয়েছে। বাকিগুলোতে নেই। শুধু তাই নয়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫০ শয্যার। এখানে ২৯ জন চিকিৎসকের পোস্ট থাকলেও আছে মাত্র ৬ জন। এ অবস্থায় জোড়াতালি দিয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের।
বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলায় ৮টি ইউনিয়ন রয়েছে। যার মধ্যে ৫টিতে চিকিৎসক দেয়া হলেও তারা দায়িত্ব পালন করছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কারণ সেখানে ২৩ জন চিকিৎসকের বিপরীতে রয়েছে মাত্র ৩ জন চিকিৎসক। যার মধ্যে একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছে।
এছাড়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ৫ জনের মধ্যেও ২ জন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন। এ অবস্থা বেহাল এই উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা। শুধু তাই নয় এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আলট্রাসনোগ্রাফি ও ইসিজি নষ্ট থাকায় রোগীদের ছুটতে হচ্ছে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতাল বা বরিশাল সদর হাসপাতালে।
উজিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জন্য ৫০ শয্যার একটি ভবন তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু জনবল কাঠামো রয়েছে ৩১ শয্যার। ১০ জন চিকিৎসকের বিপরীতে মাত্র ৩ জন চিকিৎসক দিয়ে চলছেন এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসাসেবা। যার মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শাখাওয়াত করোনায় আক্রান্ত হয়ে নিজেই চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র ৩টিতে চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হলেও তারা ডিউটি করছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।
জানা গেছে, বরিশাল বিভাগের ২৬৬ ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মধ্যে ৬৬ ইউনিয়নেও নেই চিকিৎসক। বরং ইউনিয়নের চিকিৎসক দিয়ে চলছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে এমবিবিএস চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছেন ২০১৯ সালে। কিন্তু ৩৯তম বিসিএস চিকিৎসকদের মধ্যে অধিকাংশই নিয়োগের পর আর ইউনিয়নে যাননি। কোনো কোনো ইউনিয়নে চিকিৎসকরা সপ্তাহে দুই-একবার গেলেও বাকিরা উপজেলায়ই রয়ে গেছেন।
একই অবস্থা বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলায়। সেখানে যোগদানের পর প্রায় দেড় বছরের মধ্যে একদিনের জন্যও কর্মস্থলে যাননি অনেক নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকরা। তবে নিয়মিত নিচ্ছেন বেতন-ভাতা। আর এতে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তৃণমূল পর্যায়ের রোগীরা।
বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শংকর প্রসাদ অধিকারী বলেন, ইউনিয়নের এখন ৫ জন চিকিৎসক রয়েছেন। বাকি ইউনিয়নের রোগীরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। আমরা সাধ্যমতো তাদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি।
যদিও ইউনিয়নে চিকিৎসক নিয়োগের সময় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, নিয়োগের পর এক বছর চিকিৎসকদের গ্রামে থাকতে হবে। কিন্তু সেই মন্তব্য যেন কোনো কাজে আসছে না।
এ ব্যাপারে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাস বলেন, সব ইউনিয়নে চিকিৎসক নেই। তবে অনেক স্থানে রয়েছে। যাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, করোনা মহামারি ও ডায়রিয়ার কারণে উপজেলাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
এখানেও চিকিৎসক সংকট রয়েছে। তারপরও আমরা ডায়রিয়ার মতো একটি বড় রোগ নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছি। করোনার চিকিৎসা ভালোভাবেই দেয়া হচ্ছে। সংকট সব জায়গাতেই রয়েছে, তারপরও কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।