লকডাউনের কারণে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন যৌনপল্লীর বাসিন্দারা। লোকলজ্জায় তারা বাইরে বের হতে পারেন না। পারেন না কারও কাছে কিছু চাইতে। কেউ সাহায্য নিয়েও সেখানে যান না। আর লকডাউনে খদ্দের কমে যাওয়ায় তাদের এক প্রকার না খেয়েই থাকতে হচ্ছে। এমনকি তারা চাল পানি খেয়ে সেহরি-ইফতার করেন।
দীর্ঘ ১২ বছর যাবত টাঙ্গাইল যৌনপল্লীতে বসবাস করেন শাপলা আক্তার (২৭)। আগে প্রতিদিন ৮০০-১২০০ টাকা আয় করতেন। করোনাভাইরাসের কারণে খদ্দের কম থাকায় প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা আয় হতো। এখান থেকে ঘরভাড়া, সন্তানের খরচ, খাবার ও ব্যক্তি খরচ বাদ দিয়ে তার বাড়িতে টাকা পাঠাতেন।
প্রায় ১৩ মাস যাবত করোনাভাইরাসের কারণে খদ্দের সংখ্যা কম। সবশেষ দুই সপ্তাহ যাবত লকডাউনের কারণে খদ্দের একেবারেই নাই। খদ্দের না আসায় আয় উপার্জনও বন্ধ হয়ে গেছে। লজ্জার কারণে সমাজের কারও কাছে হাত পাততেও পারেন না। সব মিলিয়ে তিনি অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
শুধু শাপলা আক্তার নয়। তার মতো টাঙ্গাইল শহরের কান্দাপাড়া যৌনপল্লীর প্রায় সাত কর্মী খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন। আবার অনেক কর্মী ঘরভাড়া দিতে না পাড়ায় বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
শাপলা আক্তার বলেন, আমার মেয়ের বয়স দেড় বছর। প্রায় দেড় বছর যাবত আমাকে কষ্ট করতে হচ্ছে। মেয়ে হওয়ার পর তিন মাস ঠিকমতো দুধ ও কাপড় কিনে দিতে পেরেছি। করোনাভাইরাসে কারণে প্রায় ১৩ মাস যাবত মেয়ের নতুন জামা ও দুধ কিনে দিতে পারি না। সুজি খাওয়ায়ে মেয়েকে মানুষ করতে হচ্ছে। বর্তমানে সুজি কেনার টাকাও থাকে না। অন্যের কাছ থেকে টাকা চেয়ে সুজি কিনে দিতে হচ্ছে। লকডাউনে গাড়ি বন্ধ। লোকজনও আসে না। সব মিলিয়ে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। এত কষ্ট বিগত ১২ বছরেও করিনি।
জানা যায়, ২০০ বছরের পুরনো কান্দাপাড়া যৌনপল্লীটি ৩০২ শতাংশ জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর ৫৯টি বাড়িতে প্রায় ৭০০ যৌনকর্মী রয়েছেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত বছরের ২০ মার্চ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিজনকে ৩০ কেজি করে চাল দিয়ে এই পল্লী লকডাউন ঘোষণা করে। এরপর ঈদুল ফিতরের আগে প্রতি সদস্যকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নগদ ৫০০ করে টাকা দেওয়া হয়।
সোমবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, লকডাউনের কারণে কান্দাপাড়া যৌনপল্লীর প্রতিটি অলিগলির রাস্তা ফাঁকা। যৌনকর্মী ছাড়া আর কেউ নেই ওই এলাকায়। আবার অনেকেই কক্ষ ছেড়ে দেওয়ায় অনেকের বাড়িতে তালা ঝুলানো দেখা গেছে।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ব্যাগ ও হাতে খাতা-কলম দেখে কয়েকজন যৌনকর্মী এগিয়ে আসেন ত্রাণসামগ্রী পাওয়ার আশায়। ত্রাণসামগ্রীর জন্য কয়েকজন তাদের নাম আগে লিখতে বলেন।
ছনিয়া আক্তার (৩৫) বলেন, খদ্দের না থাকায় কষ্ট বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। চোখের লজ্জায় কারও কাছে অভাবের কথা বলতেও পারি না। ঘরে খাবার না থাকায় প্রথম দুটি রোজা চাল পানি খেয়ে সেহরি ও ইফতার করেছি। আয় রোজগার না থাকায় পল্লীর ভিতরের সদস্যদের কাছ থেকে তাদের পুরাতন জামা কাপড় এনে পরছি।
লাকি আক্তার বলেন, দেহব্যবসা ছাড়া অন্য কোনো কাজ শিখিও নাই পারিও না। এই কাজ করে নিজের সব খরচের পাশাপাশি বাড়ির বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ওষুধ কেনার জন্য মাসে সাড়ে তিন হাজার করে টাকা দিতে হয়। প্রায় দুই সপ্তাহ যাবত তাদের টাকাও দিতে পারি না। তারা টাকা চেয়ে কান্না করেন। আমি টাকা না দিতে পেরে কান্না করি। সরকারি কোনো সহযোগিতা পেলে রোজার মাসটা কোনোভাবে কাটাতে পারতাম।
সুইটি আক্তার বলেন, আগে প্রায় প্রতি মাসে একবার করে নতুন কাপড় কিনতাম। এক বছর যাবত নতুন কাপড় কিনতে পারি না। আগের কাপড় দিয়েই চলতে হচ্ছে। আগামী ঈদেও নতুন কাপড় কিনতে পারব কিনা তাও জানি না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নারীনেত্রী বলেন, শুধু কর্মীরা মানবেতর জীবনযাপনই করছে না। আমরাও খুব কষ্টে দিন পার করছি। করোনাভাইরাসের ভয়ে এমনিতেই মানুষ আসে না। লকডাউনের কারণে আরও আসে না। সব মিলিয়ে খুব কষ্টে আছি।
নারী মুক্তি সংঘের আকলিমা আক্তার আঁখি বলেন, এই যৌনপল্লীর সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। লকডাউনের কারণে খদ্দের না থাকায় বাড়িভাড়া, খাবার খরচসহ ব্যক্তিগত খরচ জোগাতে না পেরে প্রায় ৫০ জন কর্মী পল্লী ছেড়ে তাদের বাড়িতে চলে গেছেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা টাঙ্গাইল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আজাদ বলেন, লকডাউনের জন্য অন্যান্য পেশার মতো যৌনকর্মীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কাজেই যৌনকর্মীসহ অন্যান্য পেশাজীবীদের মানবিক কারণে সরকারি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গনি বলেন, পতিতা পল্লীসহ অন্যান্য পেশার যারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন সরকারিভাবে তাদের সহায়তা দেওয়া হবে।
টাঙ্গাইল-৫ আসনের সংসদ সদস্য ছানোয়ার হোসেন বলেন, লকডাউন যেহেতু দীর্ঘ হচ্ছে- যৌনকর্মীসহ আরও যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের মধ্যে সোমবার থেকে প্রাথমিকভাবে ইফতার সামগ্রী পরিবেশন করা হচ্ছে। এছাড়াও অন্যান্য সহায়তা দেওয়ারও প্রস্তুতি চলছে বলে তিনি জানান।