২০২০ সালের শুরুতে হতাশার যে পুঁজিবাজার ছিল, সেটি এখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। করোনার সংকটকালে অর্থনীতির যে কয়েকটি খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তার মধ্যে পুঁজিবাজার অন্যতম। শুধু তাই নয়, মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও ২০২০ সালে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করেছেন উদ্যোক্তারা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২১ সালে এই বাজার একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজারে পরিণত হতে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘২০২১ সালে দেশের শেয়ারবাজার একটি শক্তিশালী বাজারে পরিণত হতে পারে।’ কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি যতদিন উন্নতি না হবে, ততদিন মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবে। এছাড়া বর্তমান কমিশন এই বাজারের উন্নয়নে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তার একটা সুফল পাওয়া যাবে।
এদিকে বিদায়ী বছরের শেষ সপ্তাহটিও হাসিমুখে পার করেছেন দেশের শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা। বড় উত্থানের কারণে গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিমাণ ২২ হাজার কোটি টাকার ওপরে বেড়ে গেছে। এর ফলে টানা পাঁচ সপ্তাহের ঊর্ধ্বমুখীতায় শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিমাণ ৫৭ হাজার কোটি টাকার ওপরে বেড়েছে। এ বিনিয়োগ বেড়েছে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার মাধ্যমে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, বড় অঙ্কের বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি সবকটি মূল্য সূচকের বড় উত্থান হয়েছে শেষ সপ্তাহজুড়ে। সেই সঙ্গে সপ্তাহের প্রতিটি কার্যদিবসে মোটা অঙ্কের লেনদেন হয়েছে। ফলে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে গেছে।
গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪৮ হাজার ২৩০ কোটি টাকা, যা তার আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৪ লাখ ২৫ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ডিএসই’র বাজার মূলধন বেড়েছে ২২ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা।
এর মাধ্যমে টানা পাঁচ সপ্তাহে ডিএসইর বাজার মূলধন বাড়লো ৫৭ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। যদিও ছয় মাস আগে অর্থাৎ জুলাই মাসের শুরুতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন ছিল ৩ লাখ ১১ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা।
বর্তমানে সেই বাজার টেকসই বাজারে রূপ নিচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ৬ মাসের মধ্যে টেকসই হবে পুঁজিবাজার। গত ২৪ ডিসেম্বর তিনি একটি পত্রিকার অনলাইন ভার্সনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে এই ঘোষণা দেন। তিনি উল্লেখ করেন, বিএসইসি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা দেবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘২০২০ সালের শেষ ছয় মাসে শেয়ারবাজারে যেভাবে উত্তরণ হয়েছে, এতে নিশ্চিত করে বলা যায়— আগামী ২০২১ সালে দেশের শেয়ারবাজার একটি শক্তিশালী বাজারে পরিণত হবে। তবে এক্ষেত্রে বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি আরও বাড়ানোর দরকার হবে।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থায় সঠিক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে এই বাজার করোনাকালেও ভালো পারফরমেন্স করেছে।’ আগামী ২০২১ সালে এই বাজার আরও ভালো পারফরমেন্স করবে বলে তিনি মনে করেন।
বাজারের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, আগের বছরের তুলনায় এ বছর আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তিনগুণের বেশি অর্থ নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। এমনকি গত তিন বছরে সম্মিলিতভাবে যে পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে, শুধু ২০২০ সালেই তার থেকে বেশি অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে।
অবশ্য আইপিও’র মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হলেও বছরের শুরুর চিত্র মোটেও ভালো ছিল না। মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ফলে এ সময় বন্ধ থাকে শেয়ারবাজারের লেনদেন।
এর আগে ২০১৯ সালে একের পর এক দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তবে গতবছরের মে মাসের শেষদিকে অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেওয়ার পর আইপিও মার্কেট সরগরম হয়ে ওঠে। তার নেতৃত্বাধীন কমিশন একের পর এক প্রতিষ্ঠানের আইপিও দিতে থাকে। ফলে মাত্র সাত মাসেই রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের সুযোগ পেয়ে যান উদ্যোক্তারা।
তথ্য পর্যালোনায় দেখা যায়, ২০২০ সালে স্থির মূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে ৫টি এবং বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৩টি কোম্পানি আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করেছে। সম্মেলিতভাবে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭০৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রিমিয়াম বাবদ তিনটি কোম্পানি নিয়েছে এক হাজার ৩৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে স্থির মূল্য (ফিক্সড প্রাইস) পদ্ধতিতে ৫টি এবং বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৩টি কোম্পানি অর্থাৎ ৮টি প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে আইপিও’র মাধ্যমে ৫৫২ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। ২০১৮ সালে ১৪টি প্রতিষ্ঠান ৬০১ কোটি ৭৫ লাখ, ২০১৭ সালে ৮টি প্রতিষ্ঠান ২৪৯ কোটি ২৫ লাখ এবং ২০১৬ সালে ১১টি প্রতিষ্ঠান ৮৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা উত্তোলন করে।
এই হিসাবে ২০২০ সালে আইপিও’র মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন হলেও আইপিওতে আসা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়েনি।
২০২০ সালে আইপিওতে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন এবং রবি আজিয়াটা লিমিটেড ও মীর আখতার হোসেন।
এর মধ্যে এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন আইপিও’র মাধ্যমে সংগ্রহ করেছে ৮৮৬ কোটি ৪৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। আর ১০ টাকা করে শেয়ার বিক্রি করা রবি উত্তোলন করেছে ৫২৩ কোটি ৭৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা।
অবকাঠামো খাতের প্রতিষ্ঠান মীর আখতার আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে থেকে নিয়েছে ১১২ কোটি ১৬ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। গত বছরটিতে আইপিও’র মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স ২৬ কোটি ৭ লাখ ৯০ হাজার, অ্যাসোসিয়েটেড অক্সিজেন ১৫ কোটি, ডমিনেজ স্টিল বিল্ডিং ৩০ কোটি এবং ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি টাকা উত্তোলন করেছে।