একসময় সেলুনে পত্রিকা রাখার চল ছিল। চুল, দাঁড়ি-গোঁফ কাটতে-ছাঁটতে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁদের অপেক্ষা করতে হতো, তাঁরা পত্রিকা পড়ে সময় কাটাতেন। সে জায়গা দখল করে নিয়েছে মুঠোফোন। মুঠোফোন থেকে ছাপার অক্ষরে ফিরিয়ে আনতে সেলুন পাঠাগারের এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন এক বইপ্রেমী।
চাকরিজীবী হারুন-অর-রশীদ (৩৮) নিজের খরচে আট জেলায় গড়ে তুলেছেন আটটি ‘সেলুন পাঠাগার’। তাঁর মূল লক্ষ্য পাঠক সৃষ্টি করা।
বইপ্রেমী হারুন-অর-রশীদের সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় প্রথম আলোর। সেলুনে পাঠাগার তৈরির আগ্রহ হলো কেন, তা জানতে চাইলে হারুন বলেন, ‘সেলুনে লম্বা সিরিয়াল থাকে। অপেক্ষার সময়টাতে সবাই ব্যস্ত থাকেন মোবাইল ফোন নিয়ে। ভাবলাম, এই সময়টাকে মোবাইল ফোনের পরিবর্তে বইয়ের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় কি না।
নবাবগঞ্জের সেলুনমালিক সুব্রতর সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি আইডিয়াটি পছন্দ করেন এবং সেখানে একটি পাঠাগার করার অনুমতি দেন। তাঁর সেলুনে বই রাখার একটি কর্নার তৈরি করে সেখানে ১০০ বই রাখলাম।’
পাঠাগারে স্টিকার সেঁটে হারুন-অর-রশীদের নাম ও ফোন নম্বর দেওয়া আছে। এখন অনেকেই ফোন করে তাঁর কাছে অন্য বইয়ের খোঁজ করেন। পড়ার আগ্রহ দেখান। হারুনের ভাষায়, গত ১০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, বই হাতে তুলে দিয়ে পাঠক সৃষ্টি করা সম্ভব।
হারুনের অনুপ্রেরণা পলান সরকার
নিজের খরচে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই বিলি করা নাটোরের পলান সরকার হারুনের অনুপ্রেরণা। বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পলান সরকার ২০১১ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে মাস্টার্স হারুন বলেন, ‘পলান সরকারের কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১১ সালে পাঠকের হাতে বিনা পয়সায় বই তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিই। ওই বছরের ডিসেম্বরে কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের তৎকালীন গণিতের শিক্ষক মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাঁর সহযোগিতায় পাঁচজন ছাত্রের হাতে বই তুলে দিই। ওই ছাত্ররা বই পড়ে ফেরত দিয়ে আবার নতুন বই নেয় আমার কাছ থেকে। ওই পাঁচজন থেকে আস্তে আস্তে অনেক শিক্ষার্থী বই নেওয়া শুরু করে।’ কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার বাসিন্দা হারুন জানান, এরপর তিনি এলাকার অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের লক্ষ্য করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই পৌঁছে দেওয়া শুরু করেন।
পড়তে দেওয়া সব বই ফেরত পান কি না, তা জানতে চাইলে হারুন বলেন, ‘৮০ শতাংশ ফেরত পাই। বাকিগুলোর জন্য আফসোস হয় না। বইগুলো তো কারও না কারও কাছেই আছে।’
করোনাকালে ঘরবন্দী মানুষের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এই সময়ে পাঠক সৃষ্টির জন্য এ পর্যন্ত ৪০০ বইয়ের রিভিউ করেছেন হারুন। গত বছর তাঁর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে সেসব রিভিউ পোস্ট করেছেন।
আট জেলায় চালু হয়েছে ‘সেলুন পাঠাগার’
এ বছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপা বাজারে ‘সুব্রত হেয়ার কাটিং সেলুন’–এ প্রথম সেলুন পাঠাগার গড়ে তোলেন হারুন-অর-রশীদ। এখন মোট আটটি সেলুন পাঠাগার চালু আছে। নবাবগঞ্জের পর হারুন যেসব সেলুনে পাঠাগার গড়ে তোলেন, সেগুলো হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার অরুয়াইল বাজারে ‘নকুল ফ্যাশন হেয়ার কাটিং’, রাজশাহী শহরের সাগরপাড়া মডেল স্কুলের সামনে ‘সাগর হেয়ার ফ্যাশন’, নাটোরের শহরে বঙ্গজ্বলে ‘শুভ হেয়ার ফ্যাশন’, শেরপুর বাসস্ট্যান্ডে ‘বুলু হেয়ার কাট’, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারপর উপজেলার জাফরাবাদ বাজারে ‘অর্জুন হেয়ার কাটিং’, মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার আরিচাঘাটে ‘মোহনা হেয়ার ফ্যাশন’ এবং নরসিংদীর ভেলানগর বাজারে ‘মানিক হেয়ার কাটিং’। জামালপুর শহরে ‘বন্ধু হেয়ার ড্রেসার’ সেলুনে পাঠাগার উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এ ছাড়া গাইবান্ধা, বগুড়া, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সেলুন পাঠাগার তৈরির কাজ এগিয়ে চলছে। প্রতিটি পাঠাগারের জন্য ১০০ বই দেওয়ার লক্ষ্য তাঁর। বই রাখার জন্য ছোট্ট কাঠামোও তিন নিজ খরচায় করে দেন।
সেলুনে এসে অনেকেই এখন বই পড়েন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় ‘নকুল ফ্যাশন হেয়ার কাটিং’ সেলুন পাঠাগারটি গত ২৯ মে চালু হয়েছে। গত ১৮ জুলাই এক কক্ষের সেলুনটিতে গিয়ে দেখা গেল, এক কোনায় চার তাকের কাচে ঘেরা শোকেসে বই রাখা। ছোট্ট এই পাঠাগার নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস রয়েছে সেলুনের স্বত্বাধিকারী খোকন বিশ্বাসের (৩০)। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ খোকন বিশ্বাসের নিজেরও বইয়ের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। প্রথম আলোকে বললেন, আগে লোকজন এসে অকারণে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করত। এখন নানা ধরনের বই পড়ে সময় পার করছে। লোকজন আগে এসেই তাড়াহুড়া করত, এখন তা করছে না। সেলুন পাঠাগারে প্রথমে ৭০টি বই ছিল। এখন বইয়ের সংখ্যা ১২৮।
সেলুনে চুল কাটাতে এসে বই পড়ছিল পাকশিমুল হাজি শিশু মিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র নাহিদ হাসান (১৬)। তার প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। নাহিদ জানাল, তার বাসা থেকে সেলুনটি কিছুটা দূর হয়ে যায়। বলল, ‘দূরে হলেও আমি এখানে আসি কিছুটা সময় বই পড়তে পারব বলে। এখানে আমার প্রিয় লেখকের অনেক বই আছে।’