পদ্মাপাড়ের মানুষ বালুমহাল বন্ধের দাবি জানিয়ে আসলেও প্রশাসনে আমলে নিচ্ছে না। বরং রাজশাহী জেলা প্রশাসন চলতি বছরে বালুমহাল, মৌজা ও দাগের সংখ্যা ছাড়াও আয়তন বাড়িয়ে দ্বিগুণ করেছেন।
রোববার জারিকৃত ইজারা নোটিশে রাজশাহীতে গোটা পদ্মাজুড়ে বালুমহাল ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। এ নিয়ে পদ্মাপাড়ের মানুষের মাঝে চরম ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, কোনো প্রকার হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে ও সরেজমিনে জরিপ ছাড়াই জেলা প্রশাসন পদ্মাজুড়ে নতুন বালুমহাল সৃষ্টি করছেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, জেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগ শুধু ভয়ংকরই নয়, পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিও।
ভুক্তভোগী মানুষের অভিযোগ, পদ্মা থেকে নির্বিচার বালু উত্তোলনের কারণে তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ভারী বালুট্রাক ও ডাম্পারের ভারে ধ্বংস হচ্ছে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়ক অবকাঠামো। আর ভয়ংকর পরিবেশ প্রতিকূলতার শিকার হচ্ছেন তারা।
তাদের আরও অভিযোগ, বালু ইজারাদাররা ইজারাকৃত এলাকার সীমানা মানেন না। বালুর বদলে নদীর উর্বর পলিমাটি লুট করছেন। নদীর জেগে ওঠা চর কেটে লোপাট করলেও প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর সাবেক জেলা প্রশাসক আব্দুল হামিদ নির্বিচার বালু উত্তোলনের ভয়াবহ প্রতিকূল প্রভাব থেকে এলাকাবাসীকে রক্ষায় গত বছর মোট ১১টি বালুমহালের মধ্যে ৫টি বন্ধ করে দেন। তবে বর্তমান জেলা প্রশাসন বন্ধ বালুমহালগুলি চালু করেননি তবে পদ্মার বুকজুড়ে নতুন নতুন এলাকা বালুমহালের আওতায় এনে নোটিশ জারি করেছেন। প্রভাবশালীরা এসব বালুমহাল ইজারা নিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন।
জানা গেছে, বিদ্যমান ৬টির সঙ্গে নতুন আরও ১২টি এলাকা বাড়িয়ে মোট ১৮টি করা হয়েছে এ বছর। পদ্মার উজানে গোদাগাড়ী থেকে ভাটিতে চকরাজাপুর পর্যন্ত এলাকায় পদ্মাজুড়ে এসব বালুমহালের অবস্থান। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বাঘার পাকুড়িয়া ইউপি এলাকাবাসী ওই এলাকার রাজাপুর চক, কিশোরপুর ও লক্ষ্মীপুর বালুমহাল বন্ধের আবেদন করেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসনে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বাঘার বালু ইজারাদাররা ইজারাকৃত এলাকার বাইরে পদ্মার বিশাল এলাকাকে বালু খাদান বানিয়ে বালু ছাড়াও নদীর পলি মাটি লুট করে চলেছেন। এতে এলাকার কোটি কোটি টাকার সড়ক অবকাঠামো ধ্বংস হচ্ছে। বালু ট্রাক ও ডাম্পারের দাপটে অন্তত ২০টি গ্রামের মানুষ দিনের বেলা ঘর থেকে বের হতে পারেন না।
এদিকে রাজশাহীর অতি ঘনবসতিপুর্ণ গোদাগাড়ী পৌর এলাকার মাদারপুর, উজানপাড়া, ভাটোপাড়া, মাটিকাটা, বারইপাড়া, কেল্লা বারুইপাড়া মিলে ৭৩ একর এলাকাজুড়ে নতুন বালুমহাল ঘোষণা করা হয়েছে।
মাদারপুরের বাসিন্দা তোবজুল হোসেনের অভিযোগ, রাজশাহীর সবচেয়ে ঘনবসতিপুর্ণ এলাকা এটি। খুবই সরু রাস্তাঘাট। এ ছাড়া নদী ভাঙ্গনরোধে এলাকায় রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বহু কোটি টাকার প্রতিরক্ষা বাঁধ। এসব এলাকা দিয়ে বালুট্রাক চললে পুরো এলাকাটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে। পাউবোর বাঁধটিও ছিন্নভিন্ন হবে। তারা কোনোভাবেই এসব এলাকা দিয়ে তুলতে দেবেন না। প্রয়োজনে এলাকাবাসী সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করবে।
অন্যদিকে গোদাগাড়ীর দক্ষিণ নির্মলচর, শেখেরপাড়া, এলাহিনগর, চরবার্ণিশ, পদ্মা নদী ও প্রেমতলী এলাকা মিলে পদ্মার ২৭০ একর এলাকাজুড়ে বালুমহাল ইজারার নোটিশ হয়েছে।
প্রেমতলী ডিগ্রি কলেজের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, গোদাগাড়ী এলাকায় পদ্মা নদী থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক বালু ও পলিমাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে রাজশাহীর একজন প্রভাবশালী ঠিকাদার। ড্রেজার দিয়ে নদীর মধ্য থেকে বালু তোলার সরকারি নির্দেশ থাকলেও নদী পাড় থেকে বালু ও মাটি লোপাট করছে। ঘর বাড়ির ভেতর দিয়ে বালু ট্রাক আর ভারী ডাম্পার বালু ও মাটি ছড়িয়ে চলাচল করছে। এলাকার পরিবেশকে দূষিত করে ফেলছে। জনবসতিপুর্ণ এলাকার বালুমহালগুলি বন্ধের দাবি জানিয়ে বহু আবেদন নিবেদন করা হলেও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না রহস্যজনক কারণে।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাত খানের অভিযোগ, নদী থেকে যেভাবে বালু উত্তোলনের নিয়ম সেটা কোনো ইজারাদারই মানেন না। চর ও নদীর পলিমাটি কেটে উজাড় হচ্ছে। বালুবাহী ভারী ডাম্পার ও বালুট্রাকের কারণে গ্রামীণ থেকে জাতীয় সড়ক অবকাঠামো দ্রুতই নষ্ট হচ্ছে। বালু ইজারা দিয়ে সরকার যে পরিমাণ টাকা পাচ্ছে-বালু পরিবহণের কারণে ক্ষতি হচ্ছে তার দশগুণ বেশি। তাছাড়া বালু দস্যুরা প্রভাবশালী হওয়ায় এলাকাবাসী তাদেরকে বাধা দিতে পারছে না।
এদিকে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, বালুমহাল ইজারার আগে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভের কথা আইনে আছে। এই ধরণের সার্ভের জন্য সময় ও বাজেট দরকার। জেলা প্রশাসন থেকে রাজশাহী পাউবোর কাছে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভের বিষয়ে বলা হয়েছিল। কিন্তু এতো কম সময়ে সেটা করা সম্ভব নয় বলে আমরা বলেছি। বালুমহাল ইজারা দেওয়ার আগে সার্ভে করে মজুদ বালুর পরিমাণ নিরূপণ করা বাধ্যতামূলক। রাজশাহীতে তা করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, কাকে কী পরিমাণ বালু ইজারা দেওয়া হচ্ছে, ওই ইজারাদার কী পরিমাণ উত্তোলন করছেন-তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা জরুরি। এটা প্রশাসনের কাজ। আর যাকে যেখানে ইজারা দেওয়া হচ্ছে তার সেখান থেকেই বালু তোলা হচ্ছে কিনা সেটাও প্রশাসনের দেখা দরকার। সেটা করা হলে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, বালু ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১৩ নামে একটি আইন আছে। জেলায় জেলায় ডিসি সাহেবরাই বালু ও মাটি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। তবে এভাবে নির্বিচারে বালুমহাল ইজারা দেওয়ার আগে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে করা ছাড়াও প্রশাসনের মনিটরিং বাড়ানো প্রয়োজন। কোনো এলাকাবাসী আপত্তি করলে তা আমলে নিয়ে দেখা উচিত।
তিনি আরও বলেন, উন্নয়ন কাজে বালু প্রয়োজন হলেও তাতে অবকাঠামো ও পরিবেশের ক্ষতির পরিমাণ ন্যুনতম করা দরকার। আমরা অধীনস্থ প্রশাসনকে সেই নির্দেশ দিয়েছি।