তাসাউফ বা আত্মশুদ্ধির মূল উদ্দেশ্য পুরোপুরি দ্বিনের ওপর চলতে সক্ষম হওয়া এবং সে গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করা, কোরআন ও হাদিসে যেগুলোকে ঈমানের অংশ বা ঈমানের পূর্ণতা লাভের শর্ত বলা হয়েছে। মূলত দ্বিনের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং ঈমানের পূর্ণতা লাভ করা পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত দুটি বিষয়।
যেসব গুণে ঈমান পূর্ণ হয় : মানুষের ঈমান পূর্ণতা পেলে সে দ্বিনের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। অথবা দ্বিনের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারলেই ঈমান পূর্ণতা লাভ করে। সুতরাং মুমিনের ঈমান ও ইসলামের পূর্ণতার সঙ্গে তাঁর আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের গভীর সম্পর্ক আছে। এ জন্য হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসে, আল্লাহর জন্যই বিদ্বেষ পোষণ করে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দান করে, আর আল্লাহর জন্যই কাউকে কোনো কিছু দেওয়া থেকে বিরত থাকে সে স্বীয় ঈমানকে পূর্ণ করল।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৬৮১)
যেসব আমলে অন্তর পরিশুদ্ধ হয় : সাধক আলেমরা আত্মশুদ্ধি লাভের প্রথম সোপান হিসেবে কতিপয় গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অনুশীলন করতে বলেন। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো—
১. আল্লাহর ভালোবাসা : মহান আল্লাহর প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসা অর্জন করা আত্মশুদ্ধির প্রধান লক্ষ্য। সালিকের (সাধক) প্রথম কাজ আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধির চেষ্টা করা। আল্লাহ বলেন, ‘যারা মুমিন, তারা আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৬৫)
২. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা : মুমিন আল্লাহর পর তার রাসুলকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। এমনকি তার নিজের চেয়ে নবীজি (সা.)-কে বেশি ভালোবাসে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তির ভেতর তিনটি গুণ থাকবে সে ঈমানের মিষ্ট লাভ করবে : ক. তার মধ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসা অন্য সব কিছু থেকে বেশি হবে, খ. কোনো মানুষের সঙ্গে তার ভালোবাসা হলে সেটাও আল্লাহর জন্যই হবে, গ. ঈমান গ্রহণের পর কুফরের দিকে ফিরে যাওয়া তার জন্য এমন অপছন্দের ও কষ্টকর হবে যেমন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া অপছন্দের।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৯৪১)
৩. মানবীয় সম্পর্কও আল্লাহর জন্য রাখা : মুমিনের মানবীয় সম্পর্কগুলো হবে আল্লাহর জন্য। সে আল্লাহর জন্য মানুষকে ভালোবাসবে এবং তার প্রতি ক্ষুব্ধ হবে। যেমন উল্লিখিত হাদিসে বলা হয়েছে, ‘কোনো মানুষের সঙ্গে তার ভালোবাসা হলে সেটাও আল্লাহর জন্যই হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৯৪১)
৪. আল্লাহর জন্য অন্তর বিগলিত করা : আল্লাহর নামে মুমিনের হৃদয় বিগলিত হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যাদের সামনে আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের অন্তর কম্পিত হয়, আর যখন তাদের সামনে আল্লাহর আয়াতগুলো তিলাওয়াত করা হয়, তখন তাদের ঈমানের জ্যোতি বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের ওপর ভরসা রাখে।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ২)
৫. আল্লাহকে ভয় করা : আল্লাহর ভয় মুমিনকে সব পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। সুতরাং আত্মশুদ্ধির জন্য আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করা আবশ্যক। ইরশাদ হয়েছে, ‘এতে (কোরআন) যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের শরীর রোমাঞ্চিত হয়, অতঃপর তাদের দেহমন বিনম্র হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে।’ (সুরা ঝুমার, আয়াত : ২৩)
৬. বেশি বেশি জিকির করা : জিকির মানবাত্মার রোগ-ব্যাধি দূর করে, অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে। পবিত্র কোরআনে বেশি পরিমাণে আল্লাহর জিকির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে (সর্বাবস্থায়) আল্লাহর জিকির করে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯১)
৭. আল্লাহর ধ্যানে নিমগ্ন থাকা : সব কিছু ছেড়ে আল্লাহর স্মরণ ও ধ্যানে নিমগ্ন হওয়ার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার অন্যতম উপায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করুন এবং একনিষ্ঠভাবে তাঁতে মগ্ন হোন।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ৮)। সর্বোপরি মুমিন আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবে, ‘হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে আপনার ভালোবাসা চাই, এমন আমল চাই, যা আমাকে আপনার কাছে পৌঁছে দেবে। হে আল্লাহ, আপনার ভালোবাসাকে আমার কাছে আমার নিজের থেকে, আমার পরিবার থেকে এবং সুমিষ্ট ঠাণ্ডা পানি থেকে প্রিয় করে দিন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৯০)