গত মাড়াই মৌসুমে চিনি উৎপাদন হার ছিল অন্য অর্থবছরের থেকে অনেক কম। গত অর্থবছরে ২৫’শ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্জিত হয় মাত্র ১৮’শ ৭১ মেট্রিক টন। এছাড়া মিলটিতে অপারেশনাল লস দেখানো হয়েছে ৩৪ কোটি ও ব্যাংক ঋণের সুদ দেখানো হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৭০ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা আর ৩৫০ কোটি টাকা ব্যাংকের দেনা মাথায় নিয়ে আবার আখ মাড়াই মৌসুম উদ্বোধন করা হয়েছে। শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) বিকেলে মোবরাকগঞ্জ চিনিকলে আড়ম্বর করে ৫৮তম মাড়াই মৌসুম শুরু করা হয়।
মোবরাকগঞ্জ চিনিকলের তথ্য মতে, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহর সংলগ্ন এলাকায় ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৭ দশমিক ৯৩ একর নিজস্ব জমির ওপর নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মধ্যে ২০ দশমিক ৬২ একর জমিতে কারখানা, ৩৮ দশমিক ২২ একর জমিতে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক কলোনি, ২৩ দশমিক ৯৮ একর পুকুর, ১০৭ একর জমিতে ইক্ষু খামার ও ১৮ দশমিক ১২ একর জমিতে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয়কেন্দ্র।
আরো জানা যায়, প্রতিষ্ঠাকালীন মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে ৬০ কর্মদিবস আখ মাড়াই করে লক্ষ্যপূরণ হওয়ায় ১৯৬৭-৬৮ মাড়াই মৌসুম থেকে বাণিজ্যিকভাবে চিনি উৎপাদন শুরু করে। ঝিনাইদহের ছয় উপজেলা ছাড়াও যশোরের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত মিলে ৮টি জোন ও ১৮ দশমিক ১২ একর জমিজুড়ে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয়কেন্দ্র।
ঝিনাইদহের ছয় উপজেলা ও যশোরের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত মিলে ৮টি জোনের আওতায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ সাড়ে তিন লাখ একর। ৪৮টি আখক্রয় কেন্দ্রর আওতায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ রয়েছে তিন লাখ একর।
মোচিক এলাকার কৃষকদের অভিযোগ, মিলের কর্মকর্তা ও সিবিএ নেতাদের লাগামহীন দুর্নীতি, কর্তব্য অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে মিলটির ঐতিহ্য হারাচ্ছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অতিরিক্ত অদক্ষ জনবল নিয়োগের ফলে মিলকে প্রতি বছর বেতন ভাতা বাবদ অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়।
আব্দুর রহমান নামে এক কৃষক বলেন, আখের মূল্য না থাকার কারণে চাষিরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়েছে। এতে ঝিনাইদহের পশ্চিমাঞ্চলের বোড়াই, নারায়ণপুর, কাশিমনগর, হলিধানী ও ঝিনাইদহ শহরের গোপীনাথপুর এলাকার আখ ক্রয় কেন্দ্র বছরের পর বছর বন্ধ রয়েছে। সেখানে এখন পালংশাক ও সবজির আবাদ হচ্ছে।
মিল সংশ্লিষ্টদের দাবি, মোচিক বন্ধ থাকলে কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাবদ বছরে ৮ কোটি টাকা আর চালালে ৫০ থেকে এক’শ কোটি টাকা পর্যন্ত লোকসান হয়। ফলে চালানোর থেকে না চালানো সরকারের জন্য ভালো। আর চালাতে হলে মিলটি আধুনিকায়ন করলে আবারও লাভের মুখ দেখতে পারবে মোচিক।
অবিশ্বাস্য চিনির উৎপাদন ব্যয় নিশ্চত করে মোচিকের জিএম (ফাইন্যান্স) হিরণ¥য় বিশ্বাস বলেন, চলতি মাড়াই মৌসুমে ৭০ হাজার টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চিনি আহরণের হার ৫.৬%।
তিনি বলেন, ২০২৩-২৪ মাড়াই মৌমুমে প্রতি কেজি চিনি উৎপাদন করতে ব্যয় হয়েছে ৩৪৯ টাকা ৫০ পয়সা। তবে কর্মচারীদের বেতন ভাতা, সরকারের ভ্যাট আইটি ও ব্যাংকের সুদ যোগ করলে উৎপাদন ব্যয় আরও বেশি হবে।
ধারাবাহিক লোকসানের কারণ ব্যাখা করে তিনি বলেন, ১৯৬৫ সালে স্থাপিত সেই পুরানো যন্ত্রপাতি দিয়ে চিনি উৎপাদন করা হচ্ছে। মিলটিতে কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। ব্রিটিশ আমলের যন্ত্রাংশে মেরামতসহ ব্যবস্থাপনা বাবদ প্রতি বছরই বাড়ছে জ্বালানিসহ অন্যান্য খরচ। এ কারণে প্রতি বছর লোকসানের বোঝা বাড়ছে। তাছাড়া আখের চাষযোগ্য জমিতে কৃষকরা কলা, ড্রাগন, পেয়ারা ও কুলসহ বিভিন্ন ফল-ফুল চাষ করছেন। এতে আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না।
মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গৌতম কুমার বলেন, নিচু জমিতে উৎপাদিত আখে চিনির উৎপাদন হার কম হয়। তাছাড়া মাড়াই মৌসুম শুরু হলে এক শ্রেণির আখচাষি ওজন বৃদ্ধি করার জন্য জমিতে সেচ ও সার প্রয়োগ করেন। ফলে চিনি উৎপাদন হার কমে যায়।
এ বিষয়ে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, মিলটির লোকসান কমাতে এবং আখের উৎপাদন বাড়াতে চাষিদের নিয়মিত সার, বীজ ও কীটনাশক সরবরাহ করা হচ্ছে।
মিল এলাকার কৃষকদের আখ চাষে উৎসাহ দিতে তাদের সচেতনতার কথা জানিয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, প্রতি বছর যে লোকসান হয় তার বেশিরভাগ ব্যাংক ঋণ ও সরকারের ভ্যাট বাবাদ পরিশোধ করতে হয়। এরপরও গত বছর মিলটিতে অপারেশনাল লস হয়েছে ৩৪ কোটি টাকা।