কয়েকদিন আগে রাজধানীর শনির আখড়ায় একটি লোকাল বাসে ভাড়া নিয়ে তুলকালামকাণ্ড ঘটে যায়। অধিকাংশ যাত্রী কন্ডাক্টরের চাহিদা অনুযায়ী ভাড়া দিলেও বেঁকে বসেন দু-তিন নিয়মিত যাত্রী। সরকারি নির্দেশার বাইরে তারা কানাকড়িও বেশি দেবেন না। বাসচালক-কন্ডাক্টর-হেলপারও নাছোড়বান্দা। এ নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি, কিল-ঘুষি ও মারামারি শুরু হয়ে যায়। যাত্রীদের মারের চোটে হেলপারের নাক ফেটে রক্ত ঝরে। এছাড়া বাড়তি ভাড়া আদায় করে তাদের মাঝে মধ্যে জরিমানাও দিতে হয়। একই রুটে বৃহস্পতিবার ১৩ টাকার স্থলে ৩০ টাকা ভাড়া নেওয়ায় রজনীগন্ধ্যা পরিবহণের একটি বাসের চালককে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বাস-চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের অভিযোগ-বাসমালিকদের চুক্তিভিত্তিক টাকা দিতে গিয়ে তাদের বাধ্য হয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে হয় এবং অন্য বাসের সঙ্গে রেষারেষিতে যেতে হয়। এজন্য যাত্রীদের সঙ্গে তাদেরই মুখোমুখি হতে হয়। মারামারি ও সংঘাতে যেতে হয়। মার খেয়ে তাদের শরীর থেকেই রক্ত ঝরে। কিন্তু বাসমালিকরা ঘরে বসে শুধু মুনাফাটা কেড়ে নেন। তাদের কারও মুখোমুখিও হতে হয় না। মার খেতেও হয় না।
রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে বাসচালক, কন্ডাক্টর ও হেলপারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কেউ বেতনভুক্ত নন। মাসিক বেতনের আওতায় তাদের নেওয়া হচ্ছে না। বাস মালিকরা পরিবহণ শ্রমিকদের দিনমজুর হিসাবেই ব্যবহার করছে। বাসচালকদের এক নেতা জানান, ২০১৮ সালের আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর মালিক সমিতি রাজধানীতে চুক্তিতে বাস চালানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত তারা আজও বাস্তবায়ন করেননি। জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে আমাদের বাস চালাতে হয়। অনেক সময় মাথা ঠিকও থাকে না। প্রতিবাদও করতে পারি না। কারণ নিজের তো গাড়ি নেই। গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলেই না খেয়ে থাকতে হয়। রাজধানীর শতকরা ৯৯ শতাংশ বাস চুক্তির ভিত্তিতে চলে।
চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে চার হাজারের মতো বাস (গাড়ি) রয়েছে। বাস মালিকদের প্রতিশ্রুতি ছিল-চালককে প্রতিদিন ১৫০০ টাকা, সহকারী চালককে ৭৫০ এবং হেলপারকে ৭৫০ টাকা দেওয়া হবে। বিনিময়ে প্রতিদিন বাসে যে পরিমাণ টিকিট বিক্রির টাকা তা মালিকের হাতে তুলে দিতে হবে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী বাসমালিককে শুক্র ও শনিবার বাসপ্রতি প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা এবং রোববার থেকে বৃহস্পতিবার বাসপ্রতি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিদিনের টাকা উঠাতে গিয়ে তাদের (চালক, কন্ডাক্টর, হেলপার) হিমশিম খেতে হয়। বাধ্য হয়েই তারা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন। প্রতিদিন সিটি করপোরেশনকে বাসপ্রতি ৬০ টাকা ‘চাঁদা’ দিতে হয়। এছাড়া পুলিশ-ট্রাফিক পুলিশদের টাকা দিতে হয়। তারা আরও জানান, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিতে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু মালিককে প্রতিদিন যে নির্ধারিত টাকা দিতে হয়, হাফ ভাড়া কার্যকর হলে আমাদের আয় কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে তো মালিক কম টাকা নেবে না। ইদানীং সড়কে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে গেছে জানিয়ে একাধিক চালক জানান, বাধ্য হয়ে সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে তাদের অতিরিক্ত ভাড়া নিতে হচ্ছে।
চালকরা জানান, আগে বাস চালাতেন জমা হিসাবে। দিনের শেষে মালিককে জমার টাকা বুঝিয়ে দিতে হতো। জমার টাকা, গ্যাস, তেল, লাইন খরচ তোলার পরে নিজের আর হেলপারের (সহকারী) আয় তোলা লাগত। এখন প্রতি ট্রিপ হিসাবে টাকা দিতে হয়। ট্রিপ কম হলে আয় কমে যায়। ট্রিপ কম হয়েছে-এমন অনুরোধ মালিকপক্ষ বোঝে না। ফলে ট্রিপের জন্য আমরা (চালক) বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালাই। এ কারণে একই রুটের (পথ) ও একই পরিবহণ এবং অন্য পরিবহণের বাসের সঙ্গে আমাদের রেষারেষি করতে হয়।
রাজধানীতে গণপরিবহণের ভাড়া নিয়ে কন্ডাক্টর ও যাত্রীদের মধ্যকার বাগবিতণ্ডা ও বচসা নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে এখন এটি ব্যাপক হারে। এখন শুধু বাস নয়, হিউম্যান হলার, লেগুনাতেও যাত্রীদের পকেট কাটা হচ্ছে। আর এসব ভাড়া নিয়ে যাত্রী ও কন্ডাক্টরদের মধ্যে বিরোধ এবং মারামারি-হাতাহাতি লেগেই থাকছে।
মোহাম্মদপুর থেকে কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত আগে লেগুনা ভাড়া ছিল ৩৫ টাকা, এখন ৫৫ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এসব পরিবহণের চালক-হেলপারদের অধিকাংশ কিশোর। ভাড়া নিয়ে উনিশ-কুড়ি হলেই তারা যাত্রীদের গায়ে হাত তোলে। এরপর মুহূর্তেই কিশোর শ্রমিকরা একত্রিত হয়ে পড়ে। তাদের বক্তব্য- কয়েকদিন ধরে ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ ও হাফ ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন-অবরোধ করা হচ্ছে। এতে অর্ধেক ট্রিপও হয় না। বাধ্য হয়ে তারা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন। তাদের অভিযোগ-কোনো মালিকই চালককে নির্ধারিত বেতন দিয়ে গাড়ি চালান না। নিত্যচুক্তিতে (নির্ধারিত টাকা) তারা গাড়ি চালান। কোনো অবস্থাতেই চুক্তির চেয়ে কম টাকা মালিককে দেওয়া যায় না। কিছু টাকা কম দিলেই গাড়ি থেকে তাদের (চালক-কন্ডাক্টর-হেলপার) নামিয়ে দেওয়া হয়। আবার গাড়ি না চালানো পর্যন্ত খেয়ে-না খেয়ে তাদের থাকতে হয়। পেটের ক্ষুধা মেটাতে গিয়ে বকাঝকা, গালিগালাজ থেকে শুরু করে মারধর সবকিছুই তাদের (শ্রমিক) সহ্য করতে হয়।
সর্বশেষ ১১ আগস্ট লকডাউন উঠে যাওয়ার পর গণপরিবহণ চলাচল শুরু হয়। তখন ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে পরিবহণ চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু বাসে উপচেপড়া ভিড় হওয়া সত্ত্বেও বাসমালিক সংগঠনগুলো ক্রমবর্ধমান অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। সর্বশেষ ৪ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বাড়ানো হয়। পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে সরকার বাসভাড়া ২৭ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করে। সিটিং ও গেটলক সার্ভিস সরকার বন্ধ করলেও সিটিং ও চেকের (ওয়েবিল) নামে অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। ডিজেলচালিত পরিবহণের ভাড়া বাড়ানো হলেও সিএনজিচালিত পরিবহণের ভাড়াও বাড়ানো হচ্ছে। ডিজেল-সিএনজি একাকার হয়ে গেছে। প্রায় ক্ষেত্রে সিএনজিচালিত বাস হলেও তাতে ডিজেলচালিত স্টিকার লাগানো হচ্ছে এবং ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া আদায় করা হচ্ছে (এক প্রকার জোর করে)। ভাড়া বাড়ানোর পর থেকে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
শতাধিক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম ও বাসভাড়া বাড়ানো একেবারে অযৌক্তিক। এছাড়া অধিকাংশ বাসে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা বাসের একাধিক স্থানে টানিয়ে রাখার নির্দেশনা মানা হয় না। ভাড়া নিয়ে কোনো ঝামেলা হলে বাসচালক, কন্ডাক্টর ও হেলপাররা অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে। তাদের অধিকংশের মুখে ভাষা জঘন্য। তাদের (চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপার) অধিকাংশ নেশাগ্রস্ত। সব সময় চোখে-মুখে ঘুমের ভাব থাকে। কখনো-সখনো তাদের মুখ থেকে মাদকের গন্ধ বেরিয়ে আসে। যত্রতত্র বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠানো-নামানো এবং বাসগুলোর মধ্যে রেষারেষিতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। যাত্রীসহ পথচারীরা মারাও যাচ্ছে।
যাত্রীরা আরও বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেই বাস-মালিকরা বাসভাড়া বাড়িয়ে দেন। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম কমলে তারা বাসভাড়া কমান না। ২০১৬ সালে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হলে বাসমালিকরা তা মানেননি। এ বিষয়ে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের এক নেতা জানান, মালিক চক্র সব সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। পরিবহণ সমিতিগুলোর শীর্ষ পদে ক্ষমতাসীন দলের নেতারাও বসে থাকেন। ফলে বিআরটিএ’র কর্মকর্তা অথবা ভ্রাম্যমাণ আদালত অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং গণপরিবহণে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বহুদিন আগে থেকেই আন্দোলন চলে আসছে। কিন্তু সরকার কোনো পদক্ষেপই নেয় না। তালিকার চেয়ে বেশি ভাড়া কেন নেওয়া হচ্ছে- এমন প্রতিবাদ করলে বাস থেকে যাত্রীদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। ঢাকার পরিবহণ মালিক সমিতির নেতারা বারবার ঘোষণা দিয়েও কথিত সিটিং সার্ভিস বন্ধ করতে ইঁদুর-বিড়াল খেলায় মেতে উঠেছে। এতে বলির পাঁঠায় পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ যাত্রীরা।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন জানান, শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া ভিক্ষা নয়-অধিকার। দেশ স্বাধীনের আগেও হাফ ভাড়া ছিল। শিক্ষার্থীরা আইডি কার্ড দেখালে হাফ ভাড়া দেওয়া যেত। এছাড়া শিক্ষার্থীরা ‘আমরা শিক্ষার্থী’ বললেই হাফ ভাড়া নিয়ে নিতেন-আইডি কার্ডও তেমন দেখা হতো না। এখন বাসমালিক-শ্রমিকরা শক্তিধর। ক্ষমতার সঙ্গেই তাদের বসবাস। প্রকাশ্যেই তারা ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে। বাসমালিক-শ্রমিকরা যতদিন ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে ততদিন তাদের নৈরাজ্য চলতেই থাকবে। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কাঁধে কাঁধ রাখায় তাদের উদ্ধত আচরণ বাড়তেই থাকবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক বলেন, সড়কে নৈরাজ্য বন্ধে শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে সোচ্চার হচ্ছে। কিছু দাবি আদায়ও করছে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে থাকবে। তাদের অধিকার বাস্তবায়নে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। আগে গণপরিবহণে শৃঙ্খলা দরকার। তিনি আরও বলেন, গণপরিবহণে এত বিশৃঙ্খল ও অপেশাদার গণপরিবহণ বিশ্বের কোথাও নেই। কোথাও সিটিং সার্ভিস বলে কিছু নেই। তাই আলাদা ভাড়া নির্ধারণ করা হয় না।