রাজধানী ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের আজ সোমবার ভোর থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। তবে সকাল হতে বৃষ্টির দাপট কিছুটা কমে যায়। সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলা বৃষ্টির প্রভাব পড়েছে নাগরিক জীবনে। ভোগান্তিতে পড়েছেন অফিসগামী মানুষ।
এর আগে রবিবার সারাদিনই ঢাকার আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল। বৃষ্টির পর আজও রাজাধানীর পুরো আকাশ কলো মেঘে ঢেকে আছে। যে কোনো সময় আবার শুরু হতে পারে তুমুল বৃষ্টি। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, দেশের বেশির ভাগ এলাকায় আজ বৃষ্টি বাড়তে পারে।
বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা বিভাগে গতকালের মতোই ভারী বৃষ্টির। বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় আজ দেশের বেশির ভাগ এলাকায় তাপমাত্রা কমতে পারে।
মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ভারী বর্ষণের সতর্কবাণীতে আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী (৪৪-৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারী (৮৯ মিলিমিটার বা এর বেশি) বর্ষণ । অতিভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে বলেও সতর্কবাণীতে জানানো হয়।
এদিকে টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের বেশির ভাগ এলাকা তলিয়ে গেছে। সড়ক-অলিগলি থেকে শুরু করে বাসাবাড়িতেও পানি। হাঁটু থেকে কমরসমান পানিতে মানুষের দুর্ভোগ চরমে। দোকানপাট ঠিকমতো খুলছে না।
অনেক বাড়িতে চুলা জ্বলছে না। যাতায়াতব্যবস্থা অনেকটা থমকে গেছে। খাতুনগঞ্জ বাজারে কেনাবেচায় ধস নেমেছে। বুধবার থেকে চট্টগ্রামে বৃষ্টি শুরু হয়।
সর্বশেষ তিন দিন ধরে টানা বৃষ্টিতে নগরীর বেশির ভাগ এলাকা তলিয়ে গেছে। খলিফাপট্টি, চকবাজার, দেওয়ানবাজার, মুরাদপুর, ষোলশহর ২ নম্বর গেট, বহদ্দারহাট, বাদুড়তলা, শুলকবহর, মোহাম্মদপুর, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, বাকলিয়া, ফিরিঙ্গিবাজার, চান্দগাঁও, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, তিন পুলের মাথা, রিয়াজুদ্দিন বাজার, মুরাদপুর, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ, কালারপোল, বড়পোল, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে আছে।
গতকাল রবিবার ২৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিতে সড়ক থেকে অলিগলি তলিয়ে গেছে হাঁটু থেকে কমরসমান পানিতে। দোকানপাট ও বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে যাওয়ায় নষ্ট হচ্ছে আসবাব।
জ্বলছে না রান্নার চুলা। এর মধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি অফিস, শিল্প ও কল-কারখানা খোলা থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন চাকরিজীবীরা। বাড়তি ভাড়া দাবি করছেন রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালকরা। উন্মুক্ত নালা ও ফুটপাতের ভাঙা স্ল্যাব পথচারীদের জন্য ঝুঁকি বাড়িয়েছে অনেকটা।
টানা বৃষ্টির কারণে ঝুঁকিতে থাকা আকবরশাহ এলাকার বিজয়নগর ও ঝিল পাহাড়ে বসবাসরত ২৫০টি পরিবারকে শনিবার দুটি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
সকাল সোয়া ৮টার দিকে নগরের জুবলী রোডের তিনপোল এলাকায় সড়কের পাশে একাধিক মার্কেটের সামনে বিভিন্ন গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১০০ কর্মী দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় প্রতিষ্ঠানের গাড়ির অপেক্ষায় থাকা নাজনীন নামের এক পোশাককর্মী দৈনিক দেশবানীকে বলেন, ‘আমরা যাব ইপিজেডে ফ্যাক্টরিতে। ৭টার দিকে গাড়ি আসার কথা। সড়কে পানির কারণে গাড়ি নাকি আটকা পড়েছে।’
কয়েক গজ সামনে যেতেই রিয়াজউদ্দিন কাঁচাবাজারের মুখে হাঁটুর বেশি পানি। লাভ লেইন থেকে নিউ মার্কেটমুখী সব ধরনের যানবাহন নিউ মার্কেটের দিকে না গিয়ে আবার লাভ লেইনের দিকে ঘুরে আসছে।
এদিকে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুরাদপুর এলাকায় ড্রেন ও সড়কে পানি একাকার হয়ে যায়। ঐ এলাকা থেকে উত্তর চট্টগ্রামমুখী বিভিন্ন বাস, মিনিবাস, সিএনজি অটোরিকশাসহ যায়। কিন্তু যানবাহন সংকটের কারণে কর্মজীবী অনেকে দাঁড়িয়ে আছেন।
দুপুর ১২টার দিকে দেওয়ানবাজার থেকে একটি সিএনজি অটোরিকশা করে বহদ্দারহাট যাচ্ছিলেন রফিক নামের এক ব্যক্তি। কিন্তু চকবাজার প্যারেড মাঠের মুখে এসে সড়কে জলাবদ্ধতার কারণে সিএনজি ওই পথ দিয়ে যাচ্ছে না। ক্ষোভ প্রকাশ করে রফিক বলেন, ‘পানির কারণে দ্বিগুণের বেশি ভাড়া দিয়ে যাচ্ছিলাম। যেদিকেই যেতে চাচ্ছি, সেদিকেই সড়কে পানি।’
দুপুর ১টার দিকে তেলিপট্টির মোড়ের সামনে কাপাসগোলা থেকে বাদুড়তলা আশপাশে প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় সড়ক-উপসড়ক ও অলিগলিতে হাঁটু থেকে কোমরের বেশি পানি। সেখানে রিকশা ছাড়া অন্য যানবাহন চলাচল বন্ধ।
বহদ্দারহাট এমএ মান্নান ফ্লাইওভারের মুখে সড়ক ভাঙাচোড়া। এর সামনে সড়কে কোমর থেকে গলা পানি। একটি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহিম উদ্দিন বলেন, ‘২ নম্বর ষোলশহর থেকে বহদ্দারহাট প্রধান সড়কে প্রায়ই সময় বৃষ্টি হলে সড়কে পানি ওঠে। চার-পাঁচ বছর ধরে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ হচ্ছে। প্রতিবছর বর্ষা এলে বলা হয়, আগামী বর্ষায় সুফল পাব। কিন্তু সুফল পেতে আর কত দিন লাগবে? আর কত দিন এভাবে ভোগান্তি পোহাতে হবে।’
এদিকে প্রধান আবহাওয়া কার্যালয় চট্টগ্রামের পতেঙ্গার পূর্বাভাস কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম গতকাল বিকেলে দৈনিক দেশবানীকে বলেন, ‘চলতি বছরে এটা সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। তিনটি কারণে চট্টগ্রামে ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এগুলো হলো মৌসুমি বায়ু প্রবলভাবে সক্রিয় থাকা, বজ মেঘ ও বায়ুর চাপে তারতম্য। আরো দুই দিন এই বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। তবে এই সময় চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের আশঙ্কা আছে।
বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে বেচাবিক্রি অনেক কম হচ্ছে জানিয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন জোয়ারের পানি এবার চাক্তাই খাতুনগঞ্জে ওঠেনি। কিন্তু তিন দিন ধরে বৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব পড়েছে। এখানের ছোট-বড় প্রায় পাঁচ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। দৈনিক গড়ে ২০০ কোটি টাকা কেনাবেচা হলেও বৃষ্টির কারণে বর্তমানে ২০ কোটিতে নেমেছে।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে করিমার ঝিরিতে গতকাল দুপুরে পাহাড়ধসে একই পরিবারের শিশুসহ চারজন আহত হয়েছে। এ সময় আহতদের উদ্ধার করে স্থানীয়রা পার্শ্ববর্তী বাইশারী বাজারে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবু তাহের জানান, পাহাড়ধসে জসিম উদ্দিনের স্ত্রী রোকসানা বেগম (২৪), মেয়ে আনিকা (৮) জেসমিন (৬) ও শাহাজালাল (দেড় বছর) আহত হয়। রোকসানাকে কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে বান্দরবানের লামা উপজেলার পৌএলাকাসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের নিচু এলাকা পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে। গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণের ফলে মাতামুহুরী নদীসহ বিভিন্ন ঝিরি ও খালের পানি বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ি ঢলের পানিতে উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। শত শত মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
এদিকে লামায় পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে প্রায় দুই হাজার পরিবার বসবাস করছে। গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসরত এলাকাগুলোতে পাহাড়ধসে হতাহতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে উপজেলা প্রশাসন ও লামা পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে কিংবা অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে।
জানা জায়, লামা উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ের চূড়া ও পাদদেশে অপরিকল্পিতভাবে বসতি গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া বৃক্ষনিধন, অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও জুমচাষের কারণে পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম দৈনিক দেশবানীকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে এ রকম বৃষ্টি থাকতে পারে আজ (সোম) ও কালও (মঙ্গলবার)। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৃষ্টিপাত আগামী বুধবার থেকে সামান্য কমতে পারে। তবে বৃষ্টি একেবারে বন্ধ হবে না। ১০ বা ১১ আগস্ট থেকে সারা দেশেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা কমে আসতে পারে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তর উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তত্সংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় আজও চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজারে আজও বহাল থাকবে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি এসে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
আজ দেশের সব বিভাগেই দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় আজ বৃষ্টি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অনেক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। সারা দেশে আজ দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। তবে রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে।