জলবায়ুজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। ঝুঁকি কমাতে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোনোটির। জলবায়ু তহবিলের প্রকল্পগুলোতেও চলছে অর্থের তছরুপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নানা দিক ও এ খাতের অনিয়ম নিয়ে শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে ১৩তম পর্ব।
জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে উপকূলীয় নদীগুলোতে লবণ পানির পরিমাণ বেড়েছে। ফলে মিঠা পানির অভাবে বিপন্ন হতে চলেছে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে জেগে ওঠা অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের চিত্রল হরিণ। পাশাপাশি দ্বীপের অন্যান্য প্রাণিকুলও হুমকির মধ্যে রয়েছে। খাদ্যসংকট, লবণাক্ত পানি প্রবেশ, ঝড় জলোচ্ছ্বাস, আবাসন সংকুচিত হওয়া, বন্য কুকুরের আক্রমণ, মিঠা পানির অভাব ও বনবিভাগের অবেহলায় এমন দৃশ্যপট দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে দ্বীপের প্রায় ৪০ হাজার হরিণের মধ্যে ৩৫ হাজারই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসবই হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট নানা দুর্যোগের কারণে। পাশাপাশি সরকারের অবহেলা ও স্থানীয়দের অসচেতনতাও এজন্য দায়ী। এ অবস্থায় খুব দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।
শুধু চিত্রা হরিণ নয়, নিঝুম দ্বীপের গহিন অরণ্যে প্রায় সাত প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৩৫ প্রজাতির পাখি ও ১৬ প্রজাতির সাপ, ২১ প্রজাতির বনজসম্পদ ও ৮৩ প্রজাতির গুল্ম ছিল। তাছাড়া কয়েক বছর আগে প্রকাশিত বন বিভাগের এক প্রকাশনায় বলা হয়েছে, দ্বীপের বনে নানান পাখির মধ্যে—শ্যামা, চিল, শকুন, পেঁচা, বউ কথা কও, মাছরাঙা, বক, ডাহুক, দোয়েল, শালিক, বুলবুলি, কোয়েল, কোয়াক, সারস, নিশি বক, কানিবক, গোবক, পানকৌড়ি, ধূসর বক, কাদাখোঁচা, বালিহাঁস, লালপা, নানান জাতের মাছরাঙ্গাসহ বিভিন্ন রকম পরিযায়ী পাখি দেখা যেতো। পাশাপাশি বেজি, বাঘদাসা, নখরবিহীন উদবিড়াল, মেছোবাঘ, গুইসাপ, অজগর ও দেখা মিলতো, যা এখন তেমন একটা দেখা যায় না।
এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, দ্বীপের চারদিকে বেড়িবাঁধ না থাকায় চরে অনায়াসে লবণ পানি ঢুকে পড়ছে। হরিণের জন্য পান উপযোগী মিঠাপানির পুকুর না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার করতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জোয়ারের সঙ্গে ভেসে যাওয়া, নির্বিচারে গাছ কাটা, নদী ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে দ্বীপের বনাঞ্চলে সাধারণ মানুষের আশ্রয় নেওয়া হরিণ বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।
এদিকে পর্যটক টানতে জলবায়ু তহবিলের টাকায় হাতিয়াসহ নিঝুম দ্বীপকে ঘিরে বিশাল পরিকল্পনা রয়েছে বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের। ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির যৌক্তিকতা উপস্থাপন করতে গিয়ে বলা হয়েছে, নিঝুম দ্বীপে বর্তমানে ২২ হাজার চিত্রা হরিণের অভয়ারণ্য রয়েছে। যদিও স্থানীয় বন বিভাগ বলছে এই দ্বীপে বর্তমানে চিত্রা হরিণের সংখ্যা ৪-৫ হাজারের বেশি হবে না। তবে হরিণের সংখ্যা নিরূপণে ২০১০ সালের পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোনও শুমারি করা হয়নি।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেখানে ২০১০ সালে দ্বীপটিতে ৪০ হাজার হরিণ ছিল, সেখানে ২০১৮ সালে এসে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজারে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। কারণ, এত দিনে হরিণের সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়ার কথা। যদিও স্থানীয় বনবিভাগের চরওসমানের (নিঝুম দ্বীপ) বিট কর্মকর্তা এসএম সাইফুর রহমান বলেন, ‘একথা সত্য যে, বর্তমানে নিঝুম দ্বীপে হরিণের সংখ্যা ৪ থেকে ৫ হাজারের বেশি হবে না। এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। বিভিন্ন বন্যায় হরিণ ভেসে যাওয়া, মানুষের অবাধ বিচরণ ও লবণ পানি অন্যতম।’
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের কারণে সৃষ্ট জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূল। এজন্য এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন তারা। তবে হাতিয়া উপজেলার এ দ্বীপটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অপার সম্ভাবনাময় এই দ্বীপে হরিণ, বনায়ন ও জীবনবৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের সঠিক কোনও পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বিগত সময়গুলোতে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় শতকোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও নিঝুম দ্বীপের হরিণের জীবন মান রক্ষায় কোনও পদক্ষেপ ছিল না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু প্রকল্পের অর্থ থেকে যেখানে, রাজধানী ঢাকায় ট্রাফিক সিগন্যাল, ফুটওভার ব্রিজ, যাত্রী ছাউনি, ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও ড্রেন নির্মাণসহ অপাত্রে ব্যয় করা হচ্ছে, সেখানে এসব বন্যপ্রাণী রক্ষায় কোনও অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে না। এখাতে সঠিকভাবে অর্থ ব্যয় করা হলে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে হুমকির মুখে পড়া এসব বন্যপ্রাণী রক্ষা পাবে। তারা জলবায়ু তহবিলের অর্থ সঠিক খাতে ব্যয় করারও দাবি জানান।
সরেজমিন দেখা গেছে, নিঝুম দ্বীপের বাগানে মিঠা পানির কোনও ব্যবস্থা নেই। দ্বীপের চার দিক মেঘনা নদী বেষ্টিত হলেও নেই কোনও বেড়িবাঁধ। ফলে নদীর লবণ পানি অনায়াসে প্রবেশ করে দ্বীপের বাগানে। কিন্তু হরিণরা কখনও লবণ পানি পান করে না। ফলে প্রাণ বাঁচাতে হরিণগুলো ভয়ভীতি উপেক্ষা করে প্রায় প্রতিদিনই ছুটে আসে লোকালয়সহ নদীর তীরে। হরিণ দেখে স্থানীয়রা তাদের ধাওয়া দেয়। আবার অনেক হরিণ ধরে জবাইও করা হয়। ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্য পাচ্ছে না সৌন্দর্যের প্রতীক মায়াবি চিত্রা হরিণ। তাছাড়া বন ও জলদস্যুরা রাতের আঁধারে শিকার করার কারণেও হরিণের সংখ্যা কমছে।
জানা গেছে, কয়েক বছর আগে দ্বীপের সাবেক বিট কর্মকর্তা মো. জাবের হোসেন হরিণের খাদ্য জোগাড়ের জন্য (বনের কেওড়া গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে দেওয়া জন্য) কয়েকটি বানর চেয়ে বন বিভাগকে বেশ কয়েকবার চিঠি লিখেছিলেন। বন বিভাগ নিঝুম দ্বীপের জন্য সাতটি বানর বরাদ্দ দিলেও সেই বানরগুলো এখনও পাওয়া যায়নি।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নিঝুম দ্বীপের একটি মা হরিণ বছরে দু’বার কমপক্ষে দু’টি করে মোট চারটি বাচ্চা দেয়। নিঝুম দ্বীপে এক সময় প্রায় ১৫ হাজারের মতো মা হরিণ ছিল। এই হিসাবে প্রতিবছর ৬০ হাজারের মতো বাচ্চা জন্মানোর কথা। এর এক-তৃতীয়াংশ বেঁচে থাকলেও বছরে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ২০ হাজার হরিণ। অর্থাৎ গত ১৩ বছরে ২ লাখ ৬০ হাজারের বেশি হরিণ হওয়ার কথা।
জানতে চাইলে চরওসমান (নিঝুম দ্বীপ) বিটের সাবেক বিট কর্মকর্তা ও বর্তমান জাহাজমারা রেঞ্জ অফিসার এসএম সাইফুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভূমি অফিস চর মাহিদের সব জমি বন্দোবস্ত দিয়ে দিয়েছে। এবারই আমি প্রথম খুব সিরিয়াস হয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সহযোগিতায় সেখান থেকে চাষাবাদকারীদের ট্রাকটরসহ সবকিছু নিয়ে এসে মামলা করেছি। পরবর্তীতে তারা যে পরিমাণ চাষ করেছিল সেটাও নষ্ট করে দিয়েছি। এর পরেও দুবাই খালের পাশে অনেক এলাকা রয়ে গেছে, যেখানে ধান হয়েছে। যেসব জমিতে ধান হয়েছে মূলত সেগুলো হরিণের বিচরণ ক্ষেত্র। দেখা যাবে, ধানখেতে গেলে মানুষ হরিণ পিটিয়ে মারবে। মানুষ অনেক সময় হরিণ মেরে গুম করে ফেলে। তবে আমার সময়ে আমি বন উজাড় করতে দেইনি। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি, যাতে কেউ বন ও হরিণ নষ্ট করতে না পারে।’
স্থানীয় বাসিন্দা শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘এক সময় হরিণের কারণে আমরা আমাদের ফসল রাখতে পারতাম না। দল বেঁধে হরিণ ফসলের জমিতে হানা দিতো। কিন্তু এখন দেখার জন্যও একটা হরিণ পাই না। পর্যটকরা এসে হতাশ হয়ে চলে যান। ফলে এখন পর্যটকদের আসাও কমে গেছে। এ কারণে আমাদের আয় রোজগারও কমেছে।’
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল শিক্ষার্থী নিঝুম দ্বীপে বেড়াতে যান। তিন দিন অপেক্ষা করেও তারা হরিণের সন্ধান পাননি। ফলে হতাশ হয়েই ফিরে এসেছেন তারা। এই দলের একজন শিক্ষার্থী জুনায়েদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বন্ধুদের হরিণ দেখানোর আশা জাগিয়ে নিঝুম দ্বীপে নিয়ে গিয়েছি। কিন্তু তিন দিন থেকেও হরিণের কোনও সন্ধান পাইনি। পরে বন বিভাগের পালিত একটি পোষা হরিণের সঙ্গে ছবি তুলে চলে এসেছি।’
স্থানীয় সংগঠন ‘দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা’র নির্বাহী পরিচালক রফিকুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ২০১২ সালে বেসরকারি কয়েকটি এনজিওকে সঙ্গে নিয়ে নিঝুম দ্বীপে হরিণের একটি সার্ভে করা হয়। এতে জাতীয় উদ্যান নিঝুম দ্বীপের হরিণ বাঁচাতে চারটি বিষয়ে কাজ করার জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ জমা দিই। সুপারিশ গুলো হচ্ছে—উঁচু জায়গা নির্মাণ, কুকুর নিধন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা ও বনের নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি। কিন্তু এখনও এর কিছুই বাস্তবায়ন করা হয়নি।’ তিনি অতি দ্রুত প্রকল্প গ্রহণ করে নিঝুম দ্বীপ ও তার আশপাশের চরাঞ্চলে বিচরণরত হরিণের জীবন রক্ষার দাবি জানান।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন সেলের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার জাকির হোসেন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিঝুম দ্বীপ আমাদের জাতীয় সম্পদ। কিন্তু একে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। হরিণ ও বন্যপ্রাণীসহ এর যেসব সম্পদ সেটাও ধ্বংস করা হচ্ছে। সরকার যদি হরিণের যথাযথ বাসস্থান ও মিঠা পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারতো, তাহলে এই ৪০ হাজার হরিণ এখন কয়েক লাখে পরিণত করতে পারতো।’ উপকূলের বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণীর তদারকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টারগুলোর তদারকিতে দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন এই জলবায়ু বিশেষজ্ঞ।