বিদেশি এয়ারলাইন্সে ফেল করা ৯ পাইলট বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে নিয়োগ পেতে একাট্টা হয়ে নেমেছেন। রাষ্ট্রীয় ক্যারিয়ারের বোয়িং ৭৭৭-৩০০ এর বহরে তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিতে তৎপর একটি সিন্ডিকেট।
এজন্য তড়িঘড়ি চূড়ান্ত করা হচ্ছে সব ধরনের পরিকল্পনা। তাদের মৌখিক পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে বিমানের এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। এজন্য সংস্থাটির এমপ্লয়মেন্ট, সিনিয়রিটি অ্যান্ড ক্যারিয়ার প্ল্যান পর্যন্ত তোয়াক্কা করা হয়নি।
জানা গেছে, প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে যাদের নাম চূড়ান্ত হয়েছে তাদের অধিকাংশই সংশ্লিষ্ট এয়ারক্রাফটে অনভিজ্ঞ। কেউ কেউ বারবার পরীক্ষা দিয়েও বিদেশি এয়ারলাইন্সে ক্যাপ্টেন হতে পারেননি।
এদের মধ্যে এ ৯ পাইলট এক সময় বিমানকে কঠিন বিপদে ফেলে দিয়েছিলেন। তারা ২০০৫ সালে রাষ্ট্রীয় এ সংস্থার চাকরির শর্ত ভেঙে একযোগে বিদেশি এয়ারলাইন্সে যোগ দিয়েছিলেন।
এতে ওই সময় পাইলট সংকটে প্রায় মাসব্যাপী বিমানের ফ্লাইট সিডিউল তছনছ হয়ে পড়ে। এদের একজন পদত্যাগপত্রও জমা দেননি। এতকিছুর পর বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ টুঁ শব্দও করতে পারেনি।
কারণ তাদের উপর ছিল তৎকালীন বিএনপি সরকারের এক শীর্ষ নেতার ভাইয়ের আশীর্বাদ। সেই ভাই তখন বিমানের প্রকৌশল বিভাগের শীর্ষ পদে কর্মরত ছিলেন। তারই দাপটে এরা নিয়মকানুন উপেক্ষা করে নির্বিঘ্ন্নে বিমান ছেড়ে গেছেন।
কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা সুবিধা করতে পারেননি। দীর্ঘদিন চেষ্টা-তদবির করেও ক্যাপ্টেন হতে পারেননি। বারবার পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছেন। ফলে চাকরি হারিয়েছেন অনেকে।
এখন সেই বিএনপি নেতার ভাইয়ের অনুসারীদেরই ফের বিমানের গুরুত্বপূর্ণ উড়োজাহাজ বোয়িং ৭৭৭-৩০০ এর বহরে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিদেশে ফেল করা চাকরি হারানো সেই পাইলটদের নিয়ে বর্তমান সরকারের সময় তৎপর হয়ে উঠেছে বিমানের সিন্ডিকেট।
এভিয়েশন গোয়েন্দাদের মতে, বর্তমানে দেশের অনেক ভিআইপি-সিআইপিসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা বিমানের এ উড়োজাহাজে ভ্রমণে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
এ নিয়োগ বাস্তবায়ন হলে পালকি, অরুণ আলো, আকাশ প্রদীপ, রাঙাপ্রভাত খ্যাত বোয়িংয়ের বহর বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ার শঙ্কা আছে বলে মনে করেন তারা।
এ ধরনের অদক্ষ এবং অনভিজ্ঞ লোকদের কেন নিয়োগ দেওয়া হবে তা নিয়ে এরই মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, বিমানের ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজগুলো পরিচালনায় বৈমানিক সংকট আছে।
এজন্য বিমান নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছে। যেহেতু এটি একটি টেকনিক্যাল বিষয়, সে কারণে নিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক শর্ত থাকে। তবে বিজ্ঞপ্তিতে যদি কোনো অসংগতি থাকে, সে বিষয়ে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। বোয়িং ৭৭৭-এর জন্য অদক্ষ বৈমানিক নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
বিমানের এমডি ও সিইও ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল বলেন, বৈমানিক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি তৈরির জন্য তাদের একটি বোর্ড রয়েছে। যেহেতু এটি টেকনিক্যাল বিষয় সে কারণে বোর্ডে বৈমানিকসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা আছেন।
তারা সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই এ বিজ্ঞপ্তি ও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। অনভিজ্ঞ আর অযোগ্যদের নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এদিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়েও নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বোয়িং-৭৭৭ উড়োজাহাজের বিজ্ঞপ্তিতে বয়সের কোনো ঊর্ধ্বসীমা দেওয়া নেই। প্রাপ্তবয়স্ক যে কেউ আবেদনের সুযোগ পাচ্ছেন। ফ্লাইট পরিচালনায় বৈমানিকের অদক্ষতায় (পাইলট এরর) পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো দুর্ঘটনা প্রমাণ হয়েছে এমন ব্যক্তি আবেদন করতে পারবেন না।
অর্থাৎ পাঁচ বছর আগে যদি নিজের অদক্ষতায় উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ঘটে এমন বৈমানিকের আবেদনের ক্ষেত্রে বাধা নেই। অভিযোগ এ শর্ত যোগ করে বেশ কয়েকজন নিজস্ব প্রার্থীকে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
বাপার এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে বিমানের বোয়িং ৭৭৭-৩০০ এর বহরের জন্য কোনো পাইলটের (ক্যাপ্টেন) সংকট নেই। উলটো ১ জন বেশি আছে। তবে বহরের কো-পাইলট সংকট আছে ১২ জন।
নিয়ম হলো বোয়িং ৭৩৭ ও ড্যাস-৮ কিউ ৪০০-এর নিজস্ব ক্যাপ্টেনদের প্রমোশন দিয়ে ঊর্ধ্বতন উড়োজাহাজ বোয়িং ৭৭৭-৩০০ এর পাইলট করা।
বর্তমানে এ উড়োজাহাজের বহরে ৩৬ জন ক্যাপ্টেন আছেন। কিন্তু সিন্ডিকেট তা না করে উলটো ৭৭৭-এর বহরের জন্য চুক্তি ভিত্তিক ক্যাপ্টেন নিয়োগ দিচ্ছে। নিয়োগের পর আবার তাদের পেছনে ট্রেনিংসহ বিভিন্ন খাতে ৩০ থেকে ৫০ হাজার ডলার খরচ করতে হবে।
বিমানের প্রশাসন শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২৫ নভেম্বর বিমানের প্রমোশন বোর্ডের বৈঠক হয়। কোনো বহরে কতজন পাইলট আছেন, কতজন প্রয়োজন, শূন্যপদ পূরণের কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা নিয়ে আলোচনার জন্যই এই বৈঠক হয়।
কিন্তু দেখা গেছে বোয়িং ৭৭৭ এবং ৭৮৭ উড়োজাহাজে তেমন ক্যাপ্টেন প্রয়োজন নেই। যে ঘাটতি আছে তা নিজস্ব এবং নিয়মিত পাইলট দিয়ে পূরণ করা সম্ভব।
মূলত এ কারণে সিন্ডিকেট তড়িঘড়ি করে প্রমোশন বোর্ডের বৈঠকের আগেই পাইলট নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়। পরবর্তীতে বৈঠক হলেও ভবিষ্যতে পাইলট সংকট হতে পারে এ আশঙ্কার কথা চিন্তা করে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
খোদ বিমান বোর্ড সভার এক সদস্য বলেন, বিমানে বর্তমানে অনেক অভিজ্ঞ পাইলট আছেন। যাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বোয়িং ৭৭৭-এর ক্যাপ্টেন করা যায়। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় সাধারণত পাইলটদের নিুপদে।
যারা নিয়মিত তারা দীর্ঘ সময় সার্ভিস দিতে পারেন। কিন্তু প্রমোশন বোর্ড এটা আমলে নেয়নি। তিনি আরও বলেন, মূলত ২০০৫ সালের দিকে যারা বিমান ছেড়ে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে যোগ দিয়েছিলেন তাদের নেওয়ার জন্যই এ প্রক্রিয়া।
বিমান পর্ষদের সাবেক এক চেয়ারম্যান বলেন, নিয়মানুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠানের কেউ চাকরি ছেড়ে দিলে তার ওই সংস্থায় আর নিয়মিত হিসাবে যোগদানের সুযোগ থাকে না।
এছাড়া যাদের নেওয়ার জন্য এত তোড়জোড় তাদের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। তারপরও তাদের কেন নেওয়া হচ্ছে। কারণ রহস্যাবৃত।
বিমানের সাবেক এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বর্তমানে যারা বোয়িং ৭৩৭ ও ড্যাস-৮এ আছেন নিয়মমতো তারাই বোয়িং ৭৭৭ যাবেন। চেইন অব কমান্ড ভাঙা হলে নিয়মিত পাইলটদের সিনিয়রিটি নিয়েও সমস্যা তৈরি হবে। তাছাড়া বিমান থেকে চাকরি ছেড়ে যাওয়া ব্যক্তিরা আবার কোন নিয়মে বিমানে ফেরত আসবেন?
বৈমানিকরা বলছেন, বোয়িং-৭৭৭ অথবা বোয়িং-৭৮৭-এর মতো উড়োজাহাজে যারা ক্যাপ্টেন হিসাবে নিয়োগ পাবেন তাদের অবশ্যই বোয়িং-৭৩৭ বা সমগোত্রীয় উড়োজাহাজের ক্যাপ্টেন হিসাবে ফ্লাই করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এক্ষেত্রে মাঝারি আকারের উড়োজাহাজেও ক্যাপ্টেন হিসাবে ফ্লাইট পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই এমন বৈমানিক যদি বড় উড়োজাহাজে ক্যাপ্টেন হিসাবে দায়িত্ব পান সেটা বড় ধরনের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
জানা গেছে, বোয়িং-৭৭৭-এর ক্যাপ্টেন পদে যে আবেদন পাওয়া গেছে সেখান থেকে যাচাই-বাছাই শেষে ১৩ জনকে পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত করা হয়। মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য ওই ১৩ প্রার্থীকে গত ২০ ডিসেম্বর ই-মেইল করা হয়।
২৩ ডিসেম্বর তাদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। মৌখিক পরীক্ষায় আটজন উত্তীর্ণ হন। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে আটজনকে ই-মেইলের মাধ্যমে সাইকোমেট্রিক টেস্টের জন্য যোগাযোগ করতে বলা হয়।
ফলাফল প্রকাশ হলেই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করবে বিমান কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ উঠেছে, মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য যে ১৩ প্রার্থীকে ২০ ডিসেম্বর ই-মেইলটি করা হয়েছিল তার মধ্যে সাতজনের সঙ্গেই বিমানের একটি পক্ষের যোগাযোগ ছিল।
বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে উড়োজাহাজের সংখ্যা ২১। এর মধ্যে ১৬টি নিজস্ব ও পাঁচটি লিজ নেওয়া। নিজস্ব বাহনগুলোর মধ্যে বোয়িং-৭৭৭-৩০০ ইআর চারটি, বোয়িং-৭৮৭-৮ চারটি, বোয়িং-৭৮৭-৯ দুটি, বোয়িং-৭৩৭ দুটি ও ড্যাশ-৮ চারটি।