যেটুকু জানা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা আসছে ফেব্রুয়ারিতেই। নেতৃত্বে থাকতে পারেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। নতুন এ দল বিএনপির ভোট ব্যাংককে টার্গেট করে এগোতে চায়। ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দেবেন জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের কবর থেকে শুরু করে চট্টগ্রামে শহীদ ওয়াসিম আকরামের কবর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে লংমার্চের মাধ্যমে এ ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
এদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিছু ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা দেখাতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির পক্ষ থেকে। সরকারে থাকা ছাত্র উপদেষ্টাদের প্রতি ইঙ্গিত করে দলটির নেতাদের অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল দাঁড়াতে চাচ্ছে। ছাত্ররা নতুন দল গঠন করলে সমস্যার কিছু নেই। তবে সরকারের অংশীজন হিসেবে কেউ নির্দিষ্ট কোনো দল বা দল গঠনের পক্ষে ভূমিকা রাখতে পারে না। এক্ষেত্রে তাদের উপদেষ্টা পদ থেকে সরে আসা উচিত।
ছাত্ররা যে নতুন দল গঠন করবে সেটির নেতা কে হবেন, তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। এ আলোচনায় সামনের দিকেই আছেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বলা হচ্ছে, তিনি উপদেষ্টার পদ ছেড়ে নতুন এই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আসতে পারেন। তবে শিক্ষার্থীদের কোনো পক্ষ বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত করেনি।
বিষয়টি নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, এখনো বিষয়গুলো চূড়ান্ত হয়নি। দলের নাম ও কারা নেতৃত্বে আসবেন তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ছাত্র উপদেষ্টাদের কেউ যদি উপদেষ্টার পদ ছেড়ে রাজনৈতিক দলের দায়িত্বে আসতে চান আমরা তাদের স্বাগত জানাবো।
তিনি বলেন, তবে এখন পর্যন্ত যেহেতু তারা (ছাত্র উপদেষ্টারা) সরকারে আছে, ফলে আমরা তাদের আলোচনায় ডাকছি না। প্রথম দিকে কেন্দ্রীয়, জেলা ও মহানগরের নেতৃত্ব ঠিক করা হচ্ছে। এরপর পর্যায়ক্রমে আমরা সারাদেশে নতুন দলের কমিটি করবো।
নতুন দল কাদের নিয়ে হবে, এটিও এখন বড় কৌতুহলের জায়গা।
নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করেন এমন সব নাগরিকের জন্য নতুন রাজনৈতিক দলের দুয়ার উন্মুক্ত। শুধু বিএনপি নয়, অন্য যে কোনো দলের যে কেউ জুলাইয়ের চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে এলে স্বাগত জানানো হবে।
‘তবে যারা অতীতে ফ্যাসিবাদী রাজনীতি তথা আওয়ামী লীগে যুক্ত ছিলেন, তাদের নেওয়া হবে না। বিভিন্ন কমিটিতে কয়েকজন অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য গোপন করে ঢুকে পড়েছিলেন। জানামাত্র তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে’- বলেন সামান্তা।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবিলা করে নতুন দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে, সে প্রশ্নও ছিল ছাত্র আন্দোলনকারী নেতাদের সামনে। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। নাগরিক কমিটির সদস্যরা আশা করছেন, নতুন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করবে।
জানা গেছে, মূলনীতি এবং কর্মসূচি যা-ই হোক, চাঁদাবাজি-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বিরক্ত থাকায় এ ইস্যুতে আত্মপ্রকাশের আগে লংমার্চ কর্মসূচি দিচ্ছেন তারা। জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূত্রগুলো জানিয়েছে, দল গঠনের পরও নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সক্রিয় থাকবে। আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও নতুন রাজনৈতিক দলের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে।
সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার পতন হলেও চাঁদাবাজি, দখলদারি বন্ধ হয়নি। এতে গণঅসন্তোষ রয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি-দখলদারত্বের জন্য দায়ী করে তারা বলছেন, এটি জনগণের কাছে তুলে ধরা হবে।
নতুন দল গঠন ঘিরে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। দলটির যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, তারা যেভাবে রাজনৈতিক দল করতে চাচ্ছে তাতে তো অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতার ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব যে কথা বলেছেন, তা সত্যি হচ্ছে। এখন কিন্তু জামায়াতসহ অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও একই কথা বলছেন।
তিনি বলেন, একজন সাধারণ মানুষকেও যদি প্রশ্ন করেন, সরকারের মধ্যে থেকে, বিশেষ করে উপদেষ্টারা যদি রাজনৈতিক দল গঠন করে, তাহলে কি প্রশ্ন উঠবে না? আমরা পত্রিকায় দেখছি, সরকারের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থাও তাদের জন্য কাজ করছে। ফলে সরকার যেমন নিরপেক্ষতা হারাবে, তেমনই ছাত্রদের এই দলও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
তবে বিএনপির এই বক্তব্য নিয়ে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, নতুন দল গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমরা উপদেষ্টাদের যুক্ত করিনি। তারা যদি আসেন তাহলে পদত্যাগ করেই আসবেন।
নাহিদ ইসলামও একাধিক সাক্ষাৎকারে বলছেন, উপদেষ্টাদের কেউ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কাজ করতে গেলে পদত্যাগ করেই যাবেন। তবে প্রশাসনে যারা বিএনপিপন্থি আছেন তাদের নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তিনি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, এর আগে তো অনেক ছাত্র আন্দোলন হয়েছে, তখন কিন্তু আমরা ছাত্রদের রাজনৈতিক দল করতে দেখিনি। এখন যারা রাজনৈতিক দল করতে যাচ্ছেন তারা কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ। কারণ, শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল সেখানে কিন্তু শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সবগুলো রাজনৈতিক দলও অংশ নিয়েছিল। সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ ঘরে ফিরে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে।
তিনি বলেন, ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়াকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের সহযোগিতা নিয়ে তারা যে দল করতে যাচ্ছে সেটা মানুষ ভালো চোখে দেখছে না। তাদের গঠনতন্ত্র, উদ্দেশ্য কী, এগুলো লিখিতভাবে প্রকাশ করুক। তখন বোঝা যাবে। তবে দলছুটদের নিয়ে গড়া কোনো দলই সফল হতে পারেনি। ফলে তাদের দল গঠনের প্রক্রিয়া পর্যন্ত আমাদের দেখতে হবে।