মাছ হচ্ছে প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং পুষ্টি সরবরাহে মাছ চাষের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা এফএও এর ২০১৮ সালের ৯ জুলাই প্রতিবেদনে দেখা যায় চাষের ও প্রাকৃতিক উৎসের মাছ মিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। ২০২০-২১ সনে দেশের বর্ধিত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রক্ষেপিত মৎস্য চাহিদা ৪৫.২৮ লাখ টন। প্রক্ষেপিত মৎস্য চাহিদা পূরণে চাষের মাছ অন্যতম ভূমিকা পালন করবে। রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলার মৎস্যচাষীগণ কার্প ফ্যাটেনিং এর যে প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছ চাষ করছেন, তা আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত নয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম-ফেজ ও (এনএটিপি ২) এর পিবিআরজি প্রকল্পের আওতায় কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প প্রভৃতি কার্প জাতীয় মাছের গবেষণা কার্যক্রম বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলাতে চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন এই প্রযুক্তির গবেষণায় গবেষকরা দক্ষিণাঞ্চলে মাছ চাষে নতুন এক সফলতা
ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছেন। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি)র জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ও শাখা প্রধান মুহাম্মাদ ইমাদুল হক প্রিন্স জানান, পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ায় তিন বছর যাবত চলা নতুন এই কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তি উপ-প্রকল্পের প্রধান গবেষক হলেন পবিপ্রবির একুয়াকালচার বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক এবং সহকারী
প্রধান গবেষক হিসেবে আছেন পবিপ্রবির ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোঃ আরিফুল আলম। উপ-প্রকল্পটির সার্বিক অর্থায়নে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এনএটিপি ২ প্রকল্প। বাজারে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, কমন কার্প প্রভৃতি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই জাতীয় মাছ দ্রুত বড় হয়, রোগাক্রান্ত কম হয়, খাদ্য ও জায়গার জন্য একে অপরের প্রতিযোগী নয়, পানির সব স্তর থেকে প্রাকৃতিক খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত হয় তাই পুকুরের পরিবেশ ভালো থাকে এবং সর্বোপরি এসব মাছ খেতে সুস্বাদু ।
দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্যচাষীগণ সাধারণত ছোট আকারের এই জাতীয় মাছ পুকুরে মজুদ করেন। এই ছোট আকারের মাছগুলোর বাজারজাতের উপযোগী হতে সাধারণত ২-৩ বছর সময় লাগে। এছাড়া ছোট আকারের মাছ পুকুরে মজুদ করলে মাছের মৃত্যুহারও অধিক হয়। কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তিতে সাধারণত বড় আকারের যেমন ৪০০-৬০০ গ্রাম ওজনের কার্প জাতীয় মাছ পুকুরে মজুদ করা হয়। এতে প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি সম্পূরক খাদ্য প্রযোগ করে ৭-৮ মাসেই মাছ বাজারজাত করা হয়। যা দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্যচাষীগণের কাছে ছিল অকল্পনীয়। কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তিতে মৎস্যচাষীগণ মাছ চাষ করে অল্প সময়ে অধিক পরিমান মাছ উৎপাদন করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। এছাড়া চাষীদের মাঝে মাছ চাষের ব্যাপক আগ্রহও সৃষ্টি হয়েছে। কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তিতে গবেষকগণ ২ টি গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। প্রথম গবেষণাতে পানির স্তরভেদে কার্প জাতীয় মাছের সংখ্যা নির্ধারণ করেছেন। দ্বিতীয় গবেষণাতে কার্প জাতীয় মাছের মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ করেছেন। তৃতীয় গবেষণাতে কার্প জাতীয় মাছের বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত সম্পূরক খাদ্য নির্ধারণে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া পানির গুণাগুণ পরীক্ষা, পাংটনের প্রাচুর্যতা, মাছে ও পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি, মাছ ও পানিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে গবেষকগণ কাজ রছেন। উপ-প্রকল্পের সুফলভোগী মো: মিলন খলিফা জানান কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের এই অঞ্চলের মৎস্য চাষীদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করে আমরা অনেক লাভবান হয়েছি এবং এই প্রযুক্তিতে মাছ চাষ করে অন্যরাও লাভবান হবেন বলে বিশ্বাস করি। আরেক সুফলভোগী মো: শামীম মাতব্বর জানান কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছ চাষে আমার নিজের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে এবং আশেপাশের মানুষের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। উপ-প্রকল্পের সহকারী প্রধান গবেষক ড. মোঃ আরিফুল আলম জানান কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তিতে মাছ চাষের ফলে কোস্টাল অঞ্চল তথা পুরো দক্ষিণাঞ্চলে কার্প জাতীয় মাছ চাষে বিপ্লব ঘটে যাবে এবং মৎস্যচাষীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ ব্যাপারে উপ-প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক জানান কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তির প্রধান বাধাঁ স্থানীয়ভাবে বড় আকারের কার্প জাতীয় মাছের অপ্রতুলতা- স্থানীয় নার্সারিগুলোতে বড় আকারের পোনা উৎপাদনসহ মৎস্যচাষীগণ চাষের পোনা কিছু সময় লালন করে মজুদ পুকুরে মজুদ করলে দক্ষিণাঞ্চলে কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
পবিপ্রবির মাননীয় ভাইস-চ্যান্সেলর (রুটিন দায়িত্ব) প্রফেসর ড. স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত বলেন, পবিপ্রবির মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের গবেষকদের সফল গবেষণায় কার্প ফ্যাটেনিং প্রযুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের মাছ চাষিদের মাঝে আশার সঞ্চার হয়েছে এবং তাদের মধ্যে কার্প জাতীয় মাছ চাষে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।