ঢাকার অন্যতম জনবহুল এলাকা গুলিস্তান, যেখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষের আনাগোনা। আর এই হাজারো মানুষের বিরক্তির অন্যতম কারণ চলার পথে ছিনতাই, চুরি, পকেটমার কিংবা ভিক্ষুকের উপদ্রব, যাদের মধ্যে প্রায়ই দেখা যায় কিছু ছিন্নমূল শিশুকে।
এই শিশুদের থাকার কোনো জায়গা নেই, মাথার উপর নেই কোনো ছাদ। যাদের দিন কাটে রাস্তায়, ফুটপাতে আর রাতের ঘুমটুকু হয় কোনো এক পার্কের বেঞ্চে বা চটের বিছানায়। যাদেরকে সাধারণত আমরা ‘পথশিশু’ বলে চিনি।
এমনি এক পথশিশুর সঙ্গে ঘটনাচক্রে আলাপ হয়ে যায় সাকিরের, তার পুরো নাম সাকির ইব্রাহিম মাটি। সাধারণত আমরা কোন পথশিশু ভিক্ষা চাইলে তাকে দু-পাঁচ টাকা দিয়ে বিদায় করে দেই, কখনো বা বিরক্ত হয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেই। কিন্তু সাকির ভাবলেন এক নতুন চিন্তা। সেই চিন্তার কথাই আজ বলছি।
যেমন চিন্তা তেমনই কাজ সাকিরের। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি ও তার বন্ধুরা মিলে যাত্রা করেন ‘পথের ইশকুল’ নামের একটি প্রি-এডুকেশনাল স্কুলের, যেখানে বিনামূল্যে পড়ানো হয় পথশিশুদের। সামর্থ্যবান মানুষের আর্থিক সহযোগিতায় আয়োজন করা হয় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মেহেদি উৎসব, ঈদ উৎসব, ফল উৎসব, শীত উৎসব, পিঠা উৎসব, আর্ট এক্সিবিশনসহ নানা অনুষ্ঠানের। আস্তে আস্তে গুলিস্তান ও তার আশপাশের এলাকার পথশিশুদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠে এ স্কুলটি।
‘পথের ইশকুলে’ ক্লাস হয় গতানুগতিক ধারা থেকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। সপ্তাহের দিন অনুযায়ী ভাগ করে নেওয়া হয়েছে বিষয়বস্তু। কখনো ক্রাফটের ক্লাসে শিশুরা শিখছে কার্ড, প্রজাপতি, ব্যাঙ, পাখাসহ নানা জিনিসপত্র তৈরি করা, আবার কখনো বর্ণ পরিচয়ের ক্লাসে পরিচিত হচ্ছে বর্ণমালার সঙ্গে। বিজ্ঞান ক্লাসে শিখছে মজার মজার বিজ্ঞান, আবার স্টোরি টেলিং ক্লাসে শুনছে তাদের পছন্দের গল্প। সেই সঙ্গে ভাগাভাগি করছে তাদের জীবনের সাদা কালো বা আনন্দ অনুভূতির গল্প, আবৃত্তি করছে কবিতা, গাইছে গান ও আঁকছে তাদের কল্পনার দুনিয়ার সুন্দর সুন্দর ছবি।
মূলত প্রথাগত শিক্ষা-ব্যবস্থায় আবদ্ধ হয়ে তাদের সুবিধাবঞ্চিত জীবনে এবং দুরন্তপনায় পড়াশোনাটা যেন বিরক্তিকর মনে না হয় তার জন্যই এ ব্যবস্থা। স্কুলটি সম্পূর্ণরূপে তরুণদের উদ্যোগে পরিচালিত এবং এই প্রি-স্কুলের এডুকেশন মডেল সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছে। গত পাঁচ বছর ধরে তাদের এ কার্যক্রম গুলিস্তানের বহু ছিন্নমূল শিশুকে নির্ভরতার একটি জায়গা দিয়েছে।
ইতোমধ্যে কিছু শিশুকে ভর্তি করানো হয়েছে মূলধারার আবাসিক স্কুলে এবং পথের ইশকুলের পরিচালকরা আশা রাখেন, তাদের সব শিক্ষার্থী একদিন মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে নিজেদের জীবনকে সফল করে তুলতে পারবে এবং অর্জিত নৈতিক শিক্ষা মনে রেখে নিজেদেরকে মানবিক ও সংবেদনশীল করে তুলবে।
‘পথের ইশকুলের’ প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান পরিচালক হলেন সাকির ইব্রাহিম মাটি। সহকারী প্রধান সমন্বয়ক উম্মে সালমা আক্তার উর্মি এবং শাখা সমন্বয়ক হলেন রাজমিন আক্তার, তারা দুজনেই ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শেষ বর্ষের ছাত্রী এবং সম্পৃক্ত আছেন স্কাউটিংয়ের সঙ্গে। এছাড়া ‘পথের ইশকুল’ পরিবারে রয়েছেন তানভীর আহমেদ, হাতিম সুলতান, মো. রইসুল ইসলাম, সাইদুল রেদোয়ান, আলি, জান্নাতুল ফেরদৌস, সোলেমান ফারুখ, সিহাব ফারাবীসহ আরও কিছু প্রাণবন্ত স্বেচ্ছাসেবক, যাদের পরিশ্রম ও ভালোবাসায় চলছে ‘পথের ইশকুল’।
করোনাভাইরাস সংক্রমণে পুরো পৃথিবী যখন ঘরবন্দি তখন ছিন্নমূল শিশুদের অবস্থা বেহাল হয়েছে পড়েছিল। খোলা আকাশের নিচে দিন কাটানো মানুষগুলোর তো ঘরই নেই। পেট চালানোর মতো অল্প কিছু টাকা জোগানোর যে রাস্তা ছিল, লকডাউনের কারণে তাও সব বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের কাছে হাত পেতে পেট ভরানোর অবস্থাও তখন আর নেই। তাদের আদরের এবং ভরসার জায়গাগুলোও হয়ে যায় ফাঁকা। কারণ তাদের ইশকুলের ভাইয়া-আপুরাও লকডাউনের কারণে বের হতে পারছেন না ঘর থেকে।
কিন্তু নিজেদের প্রিয় মুখগুলোর এই বিপদগ্রস্ত অবস্থায় তারা কয়দিন ঘরবন্দি হয়ে শান্তিতে দিন কাটাতে পারেন? তাইতো লকডাউন একটু শিথিল হলেই পিপিই পরে ছুটে যান এই বাচ্চাদের কাছে। শুরু হয় বাচ্চাদেরকে প্রতিদিন একবেলা ফ্রি খাবার বিতরণ। তবে পরিবারের বাকি সবাইকে অভুক্ত রেখে বাচ্চারা কি আর খাবার মুখে তুলতে পারে? তাই প্রথমে প্রতিদিন গুলিস্তান ও আশপাশের চল্লিশজন পথশিশু ও ভাসমান মানুষদের মাঝে খাবার বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা হলেও অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সেটা দ্বিগুণ হয়ে আশি জনে রূপান্তরিত হয়। তারপর কখনও ১০০, কখনও ১২০ বা ১৫০ জন মানুষের খাবার বিতরণ করতে থাকেন ‘পথের ইশকুলের’ স্বেচ্ছাসেবীরা। তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভালোবাসায় বহু দিন আগেই খাবার কার্যক্রমের দুইশতম দিন পার হয়ে গেলেও এখনও চলছে তাদের সব কার্যক্রম৷
শুধু খাবার বিতরণ কার্যক্রম নয়, ‘পথের ইশকুলে’ নিয়মিত দেওয়া হয় প্রাথমিক চিকিৎসা এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে মেডিকেল ক্যাম্পেইনের আয়োজন করা হয়। এমনকি মহামারীর মাঝেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবার শীতেও গুলিস্তান ও আশপাশের পথশিশু, ভাসমান মানুষদের মাঝে তিন ধাপে শীতের পোশাক ও কম্বল বিতরণ করা হয়। পথশিশুদের চাহিদা পূরণ করার পর পাহাড়ের আদিবাসীদের মাঝে বিতরণ করা হয় পাঁচশ কম্বল।
এছাড়া মহামারীতে ‘পথের ইশকুল’ দশজন ভাসমান এবং দুইজন সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে ক্ষুদ্র কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। গত ২৪ জুলাই নীলফামারীর ডিমলাতে বন্যা-দুর্গত তিনশজনকে খাবার বিতরণ এবং একশজনকে প্যাড বিতরণ করা হয়েছে ‘পথের ইশকুল’ এর পক্ষ থেকে। ধর্মীয় নিয়ম মেনে গত কোরবানি ঈদে ‘পথের ইশকুলের’ সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল পশু কোরবানি। নীল ও খোকন নামে দুই পথশিশুকে উদ্ধার এবং শাকিল ও রতনকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে ‘পথের ইশকুল’।
‘পথের ইশকুলের’ স্বেচ্ছাসেবীরা সহানুভূতি নয়, সমানুভূতি নিয়ে পাশে থাকতে চায় সবার। মানুষকে যোগ্য মানুষের মূল্যায়ন দিতে চায়। তারা অঙ্গীকারাবদ্ধ, একইসঙ্গে দায়বদ্ধ এই সমতা অর্জনের লড়াইয়ে। ‘পাশে থাকব না, পাশে থাকছি’ এ বিশ্বাসকে মননে রেখে একসঙ্গে হাঁটতে চান তারা।
ছবি কৃতজ্ঞতা: পথের ইশকুল
কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা [email protected] । সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!