দূর থেকে দেখলে মনে হবে মানুষের জটলা। তবে সেই জটলা দেখে বোঝার উপায় নেই কী হচ্ছে সেখানে। কাছে গেলে দেখা মিলবে, ফিনকি দিয়ে ছুটছে রক্ত। দায়ের কোপ আর ছুরি-চাকুর আঘাত পড়ছে বুকের ভেতর। নির্মম অত্যাচারে প্রাণটা আর ধরে রাখতে পারছে না কচ্ছপের দল। যেটা স্থানীয়দের কাছে ‘ধুর’ নামে পরিচিত। সোমবার হাটের দিন, সূর্য খানিকটা হেলে তখন জানান দিচ্ছে বিকেলের।
এটা গল্প নয়, সত্যি। বলছি, নিষিদ্ধ কচ্ছপের বাজার সাহেবেরহাটের কথা। আগৈলঝাড়া উপজেলা শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের পথ। যেখানে সপ্তাহের দুই দিন হাটে প্রকাশ্যে কচ্ছপের বাজার বসে। বরিশাল বিভাগের এটি একমাত্র কচ্ছপ বিক্রির বাজার। হাটের দিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবার সামনে ঘটছে এই হত্যাকাণ্ড। দূর-দূরান্ত থেকে চোরা শিকারির কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ সংগ্রহ করছেন। সেই কচ্ছপ এনে হাজির হন এই বাজারে। প্রকাশ্যে বসান পসরা তাঁরা। পিঠের ওপরের শক্ত খোলসবাহকরা কচ্ছপ এবং নরম খোলসবাহকরা কাছিম হিসেবে পরিচিত।
কিন্তু এ রকম খোলা বাজারে, কিভাবে বিক্রি হচ্ছে কচ্ছপ? কিনছেনই বা কারা?
এলাকায় কথা বলে জানা গেল, ওই বাজারে কচ্ছপের চাহিদা ভালোই। আশপাশের অঞ্চল থেকে তো বটেই, অনেক দূর থেকেও মানুষ কচ্ছপ কিনতে আসে এখানে। কচ্ছপের মাংস সুস্বাদু বলেই পরিচিত। তাই বিক্রিও চলছে সমানে। হোক সে বিপন্ন প্রজাতির, হোক তার বিক্রি নিষিদ্ধ। মানুষের লালসা আর চাহিদার কাছে এগুলো কোনো বাধাই নয়। আর সেই চাহিদা বুঝেই আসতে থাকে জোগান। তবে এখন ছোট আকারের কচ্ছপ মেলে। যেটি স্থানীয়দের কাছে ধুর নামে পরিচিত।
স্থানীয়রা জানায়, এখানে দেশ স্বাধীনের আগ থেকে প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে কচ্ছপ কেনাবেচার হাট বসে। তবে হিন্দু ও খ্রিস্টান সম্প্র্রদায়ের কয়েকটি উৎসবে এই বাজারে প্রায় কয়েক মন কচ্ছপের মাংস বিক্রি হয়। এমন বিশেষ দিনে বেচাকেনার চাপে বিক্রেতার কথা বলারও সুযোগ থাকে না। বস্তাবন্দি করে কচ্ছপগুলো এক সপ্তাহ আগেই নিয়ে আসা হয় বাজারে। দোকানঘর, বাড়ির ভেতর এমনকি খোলা রাস্তায় পড়ে থাকে বস্তাবন্দি কচ্ছপ। বিকেল থেকে বিক্রেতারা গলির মুখে পলিথিন বিছিয়ে তৈরি হয়ে যান নির্মম হত্যাযজ্ঞে।
এ ছাড়া আগৈলঝাড়া, কোটালীপাড়া, পসারহাট, উজিরপুর ও গৌরনদীতে চলে বিকিকিনি। সম্প্র্রতি ওই এলাকার একাধিক গোপন বাজারে গিয়ে দেখা গেল, এক ‘খুচরো’ বিক্রেতার দোকানের সামনে বেশ ভিড়। এর মধ্যেই দু-একজন নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘ধুর হবে?’ বিক্রেতা চোখের ইশারায় পেছনে থাকা গামলার দিকে ইঙ্গিত করলেন। গামলা ঝুড়ি দিয়ে চাপা। ঝুড়ির ওপরে আবার নীল রঙের পলিথিন। সেখানেই রাখা ‘ধুর’-এর দল। দরদাম সব পুষিয়ে গেলে ধুর কেটে, সাফ করে ‘পাচার’ হয় ক্রেতার ব্যাগে।
গত সোমবার বিকেলে সাহেবেরহাট বাজারে গিয়ে দেখা গেল, দুজন ধুর ব্যবসায়ী বিক্রি করছেন ৮০০-৯০০ গ্রামের কচ্ছপ। ‘কচ্ছপ বিক্রি নিষিদ্ধ সেটা জানেন?’
এই প্রশ্নের পরে আমতা আমতা করে বিক্রেতা দাবি করেন, ‘আমরা খুব একটা বিক্রি করি না। কিন্তু কচ্ছপের জন্য অনেকেই বলে রাখেন। কয়েকটি পেয়েছিলাম। তাই এনেছি।’
মৎস্যজীবীরা জানান, ছোট আকারের ধূসর রঙের ওই কচ্ছপগুলো সাধারণত পুকুর এবং দিঘিতে জন্মায়। বর্ষায় পুকুর ভরে গেলে সেগুলো ওপরে উঠে আসে। তখনই সেগুলো ধরা হয়। এ ছাড়া বিল অঞ্চলে টোটা দিয়ে কচ্ছপ ধরা হয়।
এই ‘ধুর’ আসলে ছোট আকারের কচ্ছপ। যেটার কেতাবি নাম ‘লিসেমিস পাংকটাটা’। এই ধরনের কচ্ছপ মেলে গাঁ-গঞ্জের পুকুর, ক্ষেত-জমিতে। স্থানীয়রাই এগুলো ধরে প্রতিটি গড়ে ১০০-১৫০ টাকা দরে তা মাছের আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন। জোগান ভালো থাকলে আড়তদাররা তা গড়ে ২০০ টাকা কিলোগ্রাম দরে খুচরো মাছ-বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। আড়তদারদের হাত ঘুরে ধুর চলে আসে এই বাজারে। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বা ছোট বাজারে ওই কচ্ছপ ৩৫০ টাকা প্রতি কিলোগ্রাম দরে বিক্রি করেন। তা ছাড়া কচ্ছপের মাংসের জন্য এক শ্রেণির ক্রেতাও নিয়মিত রয়েছেন বলে বিক্রেতারা জানিয়েছেন।
সাহেবেরহাটে আসা কয়েকজনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, কচ্ছপের মাংস খেলে মানুষের আয়ু বাড়ে বলে অনেকের ধারণা। কারণ কচ্ছপ অনেক বছর বেঁচে থাকে। যদিও এর পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। মানব শরীরের বিশেষ করে বাত-ব্যথা সারানোর জন্য পরিবারের অনেকে কাছিমের মাংস খেয়ে থাকে। কচ্ছপের পিঠের ওপরের শক্ত অংশ খাপরা নামে পরিচিত। খাপরাও ব্যবহার হয় ওষুধ হিসেবে। এ ছাড়া কবিরাজি ওষুধ তৈরির জন্য একসময় কাছিমের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চীনে পাচার হতো। কাছিমের খাপরার চারধারে যে নরম অংশ থাকে এর নাম বাদি। এই বাদিও বিক্রি হয় চড়া মূল্যে।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আ ক ম মোস্তফা জামান জানান, কচ্ছপ বিলুপ্তির কথা চিন্তা করে ধরা, পরিবহন, এমনকি ব্যবসা আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে কচ্ছপ সংরক্ষণের জন্য, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ নেই। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বন বিভাগের নীরবতায় বিলুপ্তের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপ। ছোট কচ্ছপগুলো পুকুর, দিঘির কাদা, পাঁক খেয়ে জল পরিষ্কার রাখে। জীববৈচিত্র্যে এদের গুরুত্ব অনেক।
কচ্ছপ থেকে ওষুধ ও চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। এসব ভুল ধারণা থেকে বের হতে না পারলে এসব বিপন্ন প্রাণীগুলো দ্রুত হারিয়ে যাবে।’