আর্থিক অসচ্ছলতা, নানামুখী প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে নিজেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে যোগ্যভাবে গড়ে তুলতে চাই অসীম ধৈর্য, অদম্য মানসিকতা আর কঠোর পরিশ্রম। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ মো. শাকিল আহমেদ সব বাধা ডিঙিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছেন নানামুখী যোগ্যতায়। তিনি একাধারে যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট স্কলার, সিএফএ চার্টার্ড, আইবিএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ডিগ্রিধারী, অর্থনীতিতে মাস্টার্স। অর্থনীতি ও ফিন্যান্স জগতে নিজেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠিত করতে করছেন গবেষণা। ফুলব্রাইট স্কলারশিপের প্রস্তুতি, আবেদনপ্রক্রিয়া, তাঁর নানামুখী কর্মকাণ্ড, পড়াশোনা, নিজেকে ধাপে ধাপে গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলেছেন বাঙ্গালীর খবর এর সঙ্গে।
নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন
২০১৯-২০ সালের ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মিডলবারি ইনস্টিটিউটে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড বিষয়ে মাস্টার্স করছি। শুরুর দিকের পড়াশোনার কথা বলতে গেলে ২০০৮ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করি। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সে ভর্তি হই। ২০১৩ সালে বিবিএ পরীক্ষা শেষ করেই একটি স্থানীয় কোম্পানিতে যোগ দিই। দুই বছর পর ইউনাইটেড ফাইন্যান্সে যোগ দিই। চাকরির পাশাপাশি আইবিএ থেকে এমবিএ করি। কিন্তু বরাবরই অর্থনীতিতে আমার আগ্রহ ছিল। তাই এমবিএর পর ২০১৭ সালে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিকসে মাস্টার্সে ভর্তি হই। তার পাশাপাশি সিএফএ করা শুরু করি। ২০১৯ সালে সিএফএ চার্টার অর্জন করি।
ফুলব্রাইট বৃত্তি সম্পর্কে জানতে চাই, কেউ যদি করতে চায় তাহলে কী কী করতে হবে?
সাধারণত প্রতিবছর মে মাসে অনলাইনে ফুলব্রাইট বৃত্তির আবেদন চাওয়া হয়। এখন আবেদনের সময় চলছে। চলবে জুনের শেষ দিন পর্যন্ত। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন শেষ করতে চাইলে একটু সময় নিয়ে আগেভাগেই আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু করা দরকার। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, থিংকট্যাংক, এনজিও ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নবীন থেকে মধ্যম পর্যায়ের কর্মীদের এ বৃত্তিতে আবেদন করতে উৎসাহিত করা হয়। আর শুধু শিক্ষক বা বিসিএস ক্যাডাররাই এই বৃত্তি পাবেন, এ ধারণা একেবারেই ভুল। করপোরেট, এনজিও বা যেকোনো পেশার লোক এ বৃত্তি অর্জন করতে পারেন। কয়েকটি নির্দিষ্ট ফিল্ডে আগ্রহীদের আবেদন চাওয়া হয়। যেমন ব্যবসায় শিক্ষা, মৌলিক বিজ্ঞানের সাবজেক্ট, ইকোনমিকস, শিক্ষা, পরিবেশ ও দুর্যোগ, ফ্যাশন ও টেক্সটাইলস, সাইকোলজি, নিরাপত্তা, সামাজিক বিজ্ঞান, সাহিত্য, ভাষা, জনপ্রশাসন ও পাবলিক পলিসি, নগর–পরিকল্পনা ইত্যাদির ওপর আগ্রহী ব্যক্তিরা আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু করে দিতে পারেন।
ফুলব্রাইট বৃত্তিপ্রাপ্তদের নানা ধরনের সুবিধা দেয় আমেরিকান সরকার। টিউশন ফি, পড়াশোনার খরচ, যাতায়াতের বিমান ভাড়া, মাসিক একটি নির্দিষ্ট ভাতা, স্বাস্থ্যবিমা, এবং বইপুস্তক ও আনুষঙ্গিক খরচ দিয়ে দেয়। প্রতিবছর এ বৃত্তি প্রদান করা হয়।
প্রাথমিক যোগ্যতা হিসেবে ৪ বছর মেয়াদি স্নাতক ডিগ্রির সঙ্গে ২ বছর কাজের অভিজ্ঞতা লাগে। এর সঙ্গে টোফেলে ন্যূনতম ৮০ স্কোর অথবা আইইএলটিএসএ ৭.০০ থাকতে হয়। অনেকেই মনে করে, জিআরই ছাড়া আবেদন করা যায় না, তাঁদের ধারণা ভুল। আগে জিআ ই দেওয়া থাকলে সমস্যা নেই, তবে না থাকলে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের ফুলব্রাইট কর্তৃপক্ষের খরচে জিআরই দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
আবেদনের সঙ্গে পারসোনাল স্টেটমেন্ট, স্টাডি অবজেক্টিভ ধরনের কয়েকটি রচনা লিখে অনলাইনের আবেদন ফরমে আপলোড করতে হয়। সঙ্গে তিনটি রেকমেন্ডেশন লেটার, একটি রেজিউমে, টোফেল/ আইইএলটিএস স্কোরসহ আবেদন করতে হয়। নির্বাচিত হলে জিআরই পরীক্ষা দিতে হয়। আবেদনে রচনা অংশটুকু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভাইভাতে ডাকা পাওয়ার জন্য এটিকে যত্নের সঙ্গে লেখা উচিত। অনেক আবেদনকারী থেকে কাঙ্ক্ষিত প্রার্থী বেছে নিতে রচনাগুলোর গভীরতা, সামঞ্জস্যতা, ক্যারিয়ার প্ল্যানের সঙ্গে মিল দেখা হয়। আবেদনে যদি কেউ দেখাতে পারেন, তিনি যে বিষয়ে পড়ার জন্য আবেদন করেছেন, তা তাঁর আগ্রহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ভবিষ্যতে সহায়তা করবে, তাহলে ফুলব্রাইট বৃত্তি পাওয়া সম্ভব।
ফুলব্রাইটে আবেদনের আগেই আমার জিআরই ও টোফেল দেওয়া ছিল। নির্বাচিত হওয়ার পর পুনরায় জিআরই দিই। জিআরই এবং টোফেল পরীক্ষা আপনার ইতিমধ্যে অর্জিত জ্ঞানের ওপর পরীক্ষা। কিন্তু ইচ্ছা করলে যেকোনো মুহূর্তে পড়াশোনা করে উন্নতি করতে পারবেন। যত আগে শুরু করা যায়, ততই ভালো। এই পরীক্ষাগুলোর প্রস্তুতিতে প্রধান সমস্যা হলো অতি ধীরগতির উন্নতি। তাই অনেকেই যথাযথ উন্নতি হচ্ছে না ভেবে হাল ছেড়ে দেন। তাই ধৈর্য রাখতে হবে, নিজের ওপর আস্থা রেখে অনেক বেশি প্র্যাকটিস করতে হবে। সব সময় গণিত ও ইংরেজির অল্প অল্প চর্চা থাকলে পরীক্ষার আগে প্রস্তুতি খুব সহজ হয়ে যায়।
আমেরিকার ফুলব্রাইট বৃত্তির আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলবে পুরো জুন মাস। ছবি: সংগৃহীত
আমেরিকার ফুলব্রাইট বৃত্তির আবেদনপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চলবে পুরো জুন মাস। ছবি: সংগৃহীত
ফুলব্রাইটে ভাইভার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
ভাইভাতেই আমার আবেদনপত্রের বিভিন্ন বিষয়, রেজিউমে এবং ক্যারিয়ার নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। নিজের ওপর আস্থা রাখা সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। নিজের শক্তির জায়গাগুলো ভালোভাবে জেনে যেতে হবে। ভাইভা বোর্ডে জানতে চায়, যা বলছেন তা সম্পর্কে আপনি নিজে নিশ্চিত কি না। এটা বোঝানো গেলে ভাইভার সফলতা অনেকাংশে বেড়ে যায়। আবেদনে বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা চাইবে, কী পড়তে চান, কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে চান, সেটা কীভাবে পরে দেশে কাজে লাগাবেন, সেসব বিষয় জানতে চাইবে। আবেদনের সময় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় চয়েস দিতে হয়, কোন বিশ্ববিদ্যালয় কেন চয়েস দেওয়া হয়েছে, সেটি গুছিয়ে ভালোভাবে বলতে হবে। সর্বোপরি আত্মবিশ্বাসী থাকতে হবে। ভালো ফল থাকলে ভালো, ফলাফল খারাপ হলেও অন্য বিষয়গুলো দিয়ে পুষিয়ে নেওয়া যায়।
আইবিএ–এমবিএর ভর্তির জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন?
আইবিএর প্রস্তুতির জন্য আগের বছরগুলোর প্রশ্নপত্র নিয়ে একটা অ্যানালাইসিস করেছিলাম। বুঝেছি, চেষ্টা করেছি কোথায় দুর্বলতা আছে। দুর্বল বিষয়ে বেশি বেশি প্র্যাকটিস করতাম। আমার অ্যানালাইটিক্যাল অ্যাবিলিটিতে দুর্বলতা ছিল। সময় বেশি লাগত উত্তর দিতে। প্র্যাকটিসের ফলে আস্তে আস্তে উত্তর দেওয়ার সময় কমে আসে। আইবিএ ভর্তি পরীক্ষায় বেসিক প্রশ্ন করা হয়, কিন্তু সময় কম থাকে। তাই অনেক বেশি প্র্যাকটিস দরকার। এই প্র্যাকটিস পরে জিআরই পরীক্ষায় কাজে লেগেছে। আর সব সময় নতুন ইংরেজি শব্দ শেখার চেষ্টা করেছি। আসলে শব্দ শিখতে হবে, মুখস্থ নয়। যখনই কোনো শব্দ নতুন পাওয়া যায়, তখনই সেটা নিয়ে কিছু লিখতে হবে। শব্দকোষে অন্যান্য ব্যবহার দেখতে হবে। একই শব্দের অনেক ব্যবহার থাকে, পরীক্ষায় অনেক ধরনের ব্যবহারই বেশি আসে।
সিএফএ কেন কীভাবে করা যায়?
ফিন্যান্সে যাঁদের আগ্রহ আছে এবং ভবিষ্যতে ফিন্যান্সে ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাঁরা সিএফএ (CFA—Chartered Financial Analyst) করতে পারবেন। যেকোনো বিষয়ে অনার্স করে তিন ধাপে পরীক্ষা দিয়ে আন্তর্জাতিকে ডিগ্রি অর্জন করা যায়। এটি সময় দিয়ে পড়াশোনা করলে যাঁদের ফিন্যান্স বেসিক নেই, তাঁরাও অর্জন করতে পারবেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাকরি বাজারের জন্য প্রস্তুত করতে পারবেন। দুনিয়াতেই চাহিদার তুলনায় পাস করা লোকবল অনেক কম থাকে।
এর বাইরে আর কী কী পড়েছেন?
সব সময় কোনো না কোনো উপায়ে পড়াশোনায় যুক্ত ছিলাম। যখনই সুযোগ পেয়েছি, নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করেছি। পরীক্ষায় পাসের চেয়ে বেশি মনোযোগ ছিল নতুন যা শিখলাম, কীভাবে সেটাকে কাজে লাগাব। এখন বুঝতে পারছি, যা শিখেছি সবই কাজে লাগছে। যখন ফিন্যান্স পড়েছি, তখন মনে হয়েছিল অর্থনীতির জ্ঞান ছাড়া ফিন্যান্স সম্পূর্ণ না। তাই পরে ইকোনমিকসে মাস্টার্স করি। এখন যুক্তরাষ্ট্রে যা পড়ছি, তা একধরনের ফলিত অর্থনীতি। অনেক অনলাইন ফ্রি কোর্স করেছি। কোর্সেরা (Coursera.org) একটি অনলাইন কোর্স করার ওয়েবসাইট। যেকোনো বিষয়ে শেখার আগ্রহীদের জন্য এটি অনেক উপকারী। কিছু শিখতে ইচ্ছা হলে কোর্সেরাতে গিয়ে শিখতাম। একটু একটু করে ৩০টির মতো কোর্স করেছি। এখনো করছি। আমার কাছে এর চেয়ে ভালো ইন্টারনেটের ব্যবহার আর নেই। নানা জিনিস পড়ার কারণে একসঙ্গে বহু দিক ভাবতে পারি, যা আমার গবেষণাতে অনেক কাজে লাগছে। অর্থনীতি ও ফিন্যান্স নিয়ে আন্তর্জাতিক জার্নালে ৪টি ও দেশীয় জার্নালে ১টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। আরও কিছু গবেষণা চলছে।
পড়াশোনায় সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কী? জীবনে চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করেছেন?
পড়াশোনায় সবচেয়ে অনুপ্রেরণা মা-বাবা। আব্বা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ বিভাগে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ছিলেন। কষ্ট করেছেন, কিন্তু কখনো আমার পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটাননি। আমার মা কখনো শিক্ষার আলো পাননি, কিন্তু তাঁর চেয়ে বেশি শিক্ষার মূল্য আজ পর্যন্ত কাউকে বুঝতে দেখিনি। সব সময় পড়তে বলেছেন। পড়াশোনা বাদ দিয়ে শুধু টাকা উপার্জন করতে কখনো বলেননি। যখন ছোট ছিলাম, আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। মা সবকিছু সহ্য করেছেন, আমাদের বুঝতে দেননি। আমার ৩ বোন এবং আমি, সবাইকে তিনি শিক্ষার আলো দিয়েছেন। বড় বোন আজ মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের বুটিক প্রশিক্ষক, মেজো বোন ইডেন কলেজে ফিন্যান্সে এমবিএ করছে। ছোট বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় অনার্স করছে। আমরা সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত আজকে শুধু তাঁর জন্য। পড়ায় আনীহা এলেই মায়ের কথা মনে করি। ছাত্রজীবনে সব সময় একাধিক টিউশনি করতে হয়েছে, পারিবারিক প্রয়োজনে বিবিএ পরীক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি শুরু করি। নিজের বা পরিবারের সমস্যাকে পড়াশোনা না করার অজুহাত হিসেবে চিন্তা করিনি। সব সময় মনে করতাম, পারিবারের আর্থিক সমস্যার সমাধান করেই নিজেকে এগিয়ে নিতে হবে। সব সময় মনে রাখতাম, যদি এসব সমস্যার কারণে আমি আটকে যাই, তাহলে নিজেই ঠকে গেলাম, অজুহাত হিসেবে ভবিষ্যতে এগুলো কাজে আসবে না।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী?
ইচ্ছা আছে ফিন্যান্সিয়াল বা ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিকসে পিএইচডি করার। এরপরে কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা। আর সুযোগ পেলে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় বা অনলাইন ফোরামে অর্থনীতি বা ফিন্যান্স নিয়ে লেখালেখি করি, সেটিও চলমান রাখব।