ধরলা নদীর ভাঙনে জামিলা বেগমের ভিটা গেছে, ঘরও গেছে। জমি কিনে বাড়ি করার মতো আর্থিক সামর্থ্যও ছিল না। ৫ বছর ধরে থাকছেন অন্যের আশ্রয়ে। সেই জামিলার দুঃখ ঘুচতে যাচ্ছে আজ। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় তিনি একটি আধা পাকা ঘর পাবেন।
জামিলার বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগভাঙ্গা ইউনিয়নে। নতুন বরাদ্দ পাওয়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জামিলা বলেন, ‘ছিলাম ভূমিহীন, এখন জমি ও ঘরের মালিক। খুশি খুশি লাগছে।’ ১৫ জানুয়ারি ঘরের ২ শতাংশ জমিও তাঁর নামে লিখে (বন্দোবস্ত) দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
জামিলা বেগমের মতো সারা দেশে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে আধা পাকা ঘর দিচ্ছে সরকার। এ ছাড়া ৩৬টি উপজেলায় ৭৪৩টি ব্যারাক নির্মাণের মাধ্যমে আরও ৩ হাজার ৭১৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মুজিব বর্ষের উপহার হিসেবে ৬৯ হাজার ৯০৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমিসহ ঘর দিচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ শনিবার সকালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছেন।
জামিলা বেগমের পাশের ঘরে ছিলেন দেলো বেগম। তাঁর বয়স ৮০ বছরের বেশি। তাঁর জীবনের গল্পটা ভিন্ন। তাঁর স্বামীর জায়গা–জমি ছিল না। স্বামী-সন্তান নিয়ে তিনি ছিলেন বাবার দেওয়া জমিতে। কিন্তু সেই জমি প্রতারণা করে লিখে নেন এক প্রতিবেশী।
৪৫ বছর আগের সেই ঘটনা আজও দেলো বেগমকে পীড়া দেয়। বললেন, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ভুলতে পারি না। তিনি বলেন, ‘শ্যাষ বয়সে আইসা জমি ও ঘর পাব, কোনো দিন ভাবতে পারি নাই। শেখ হাসিনা ঘর দিছে, আল্লায় তাক শান্তি দিক।’
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগভাঙ্গার এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে জমি ও ঘর পেয়েছে ১৬টি পরিবার। গতকাল শুক্রবার সকালে সেখানে গিয়ে আরও অনেকের অজানা গল্পগুলো জানা গেল। যেমন ভূমিহীন পরিচয়টি খুব কষ্ট দিত ষাটোর্ধ্ব আবদুল হামিদকে। তিনি দিনমজুরি করেন। অভাবের সংসারে দিন এনে দিন খেতে চলে যায়। তারপরও একবার কষ্ট করে ২ শতাংশ জমি কেনার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলের অসুখের পেছনে চিকিৎসায় তা আর হয়নি।নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে আবদুল হামিদ বললেন, গ্রামে জমি না থাকলে কেউ মূল্য দেয় না। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। সেই কষ্ট আর থাকবে না। বললেন, ‘সরকার হামাক ২ শতক জমি নিকি দিচে, হামরা খুউব খুশি হইছি।’
ঘর পাওয়ার আনন্দে দেয়ালে নিজের ও স্বামীর নাম লিখেছেন মিষ্টি। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়িতে গতকাল ছবিটি তোলা।
নতুন বরাদ্দ পাওয়া ঘরের দেয়ালে নিজের ও স্বামীর নাম আলপনায় এঁকেছেন মিষ্টি বেগম। ৭ বছর আগে তিনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। স্বামীর ভিটেবাড়ি না থাকায় তাঁকে থাকতে হয়েছে বাবার বাড়িতে। আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে ঘর পেয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নীলুফা ইয়াসমিন বলেন, এই এলাকাটিতে ভূমিহীন ও নদীভাঙনকবলিত মানুষের সংখ্যা বেশি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এসব পরিবার ছিন্নমূল জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার বেরুবাড়ি ইউনিয়নের বানিয়ারকুটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে শুক্রবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, বন্যার সময় করা আশ্রয়ণকেন্দ্র ও আশ্রয়ণ প্রকল্প পাশাপাশি। এখানে নির্মাণ করা হয়েছে ৪০টি ঘর। আশ্রয় পাবে ৪০টি পরিবার।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল মোতালেব বললেন, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে দুধকুমার নদের দূরত্ব আধা কিলোমিটার। এলাকাটি বন্যাকবলিত। দুধকুমার নদের ভাঙনে ভিটাহারা কিছু পরিবার ঘর পেয়েছে।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল করিম বলেন, সারা দেশে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় কুড়িগ্রাম জেলার ৯টি উপজেলায় ১ হাজার ৫৪৯টি পরিবার ২ শতাংশ করে জমি ও একটি ঘরে আধা পাকা ঘর পাবে।
বানিয়ার কুটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের পশ্চিম পাশে ঘর পেয়েছেন আনোয়ার হোসেন। তাঁর ঘরে ঢুকে দেখা গেল, একটি রুমের দরজা নতুন পর্দা দিয়ে সাজানো। আনোয়ারের স্ত্রী রাশেদা বেগম বলেন, নতুন ঘর পাওয়ায় তিনি খুশিতে পর্দা কিনে এনেছেন।