ওই শহরের দুটো মসজিদে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী ব্রেন্টন টারান্টের বন্দুক হামলায় ৫১ জন নিহত হওয়ার পর এই তদন্ত শুরু হয়।
কমিশনের তদন্তে দেখা গেছে হামলা চালানোর আগে হত্যাকারী বিপুল অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় এবং দেশটিতে আগ্নেয়াস্ত্র সংক্রান্ত যেসব আইন আছে সেসব বাস্তবায়নেও কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে।
তদন্তে আরো বলা হয়েছে নিউজিল্যান্ডের কর্মকর্তারা ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদের বিষয়েই বেশি মনযোগী ছিল।
তবে তদন্ত রিপোর্টে এও উল্লেখ করা হয়েছে: এসব ব্যর্থতা সংশোধন করা হলেই যে এই হামলা থেকে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ব্রেন্টন টারান্টকে থামানো যেত তা নয়।
এবছরের অগাস্ট মাসে ব্রেন্টন টারান্টের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।
মসজিদে হত্যাকাণ্ডের পর নিউজিল্যান্ডের পুলিশ বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ উদ্ধার করেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে: হত্যাকারীর স্টেরয়েড ব্যবহার, দুর্ঘটনাবশত নিজের করা গুলিতে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং চরমপন্থীদের ওয়েবসাইটে যাওয়া।
তবে তদন্ত শেষে বলা হচ্ছে, এরকম একটি হামলা যে হতে পারে এসব থেকেও তা অনুমান করা সম্ভব ছিল না।
“এই সন্ত্রাসীর পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি সম্পর্কে জানার বিষয়ে কমিশন সরকারি কোন সংস্থার ভেতরে কোন ধরনের ব্যর্থতা খুঁজে পায় নি,” তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর একথা বলেছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডের্ন।
“তবে তারা কিছু বিষয় চিহ্নিত করেছে যেগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে এবং এগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তনও প্রয়োজন।”
তিনি উল্লেখ করেন: “আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের ব্যাপারে ব্যর্থতা” এবং “প্রচুর পরিমাণে সম্পদের সংগ্রহ” থেকে ইসলামপন্থীদের হুমকি সম্পর্কে ধারণা করা যেত।
“কমিশন যখন বলছে যে এসব জানা গেলেও হামলা থামানো যেত না, তারপরেও এগুলো ব্যর্থতা এবং এসব কারণে সরকারের পক্ষ থেকে আমি দুঃখ প্রকাশ করছি।”
রিপোর্টে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে এবং সরকার বলছে যে তারা এগুলো সবই গ্রহণ করবে। তার মধ্যে রয়েছে নতুন একটি জাতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থা প্রতিষ্ঠা এবং পুলিশ যাতে খুব দ্রুত বিদ্বেষমূলক অপরাধ চিহ্নিত করে সেসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে তার উদ্যোগ নেওয়া।
এর পাশাপাশি সরকার জাতিগত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং তাদের জন্য শিক্ষামূলক কিছু কর্মসূচি গ্রহণেরও পরিকল্পনা করছে।
ক্রাইস্টচার্চ শহরের যে দুটো মসজিদে হামলা চালানো হয়েছিল তার একটি আল নূর মসজিদের ইমাম বলেছেন রিপোর্টে নিশ্চিত করা হয়েছে যে মুসলিমদের রক্ষার পরিবর্তে তাদের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সন্দেহ ছিল বেশি।
“আমরা অনেক দিন ধরেই জানি যে মুসলিমরা ঘৃণা ও বিদ্বেষ-জনিত বক্তব্য ও অপরাধের শিকার হচ্ছে। এই রিপোর্ট দেখিয়ে দিয়েছে যে আমরা সঠিক,” বলেন গামাল ফৌদা।
“তদন্ত রিপোর্ট দেখিয়ে দিয়েছে যে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ভেতরে প্রাতিষ্ঠানিক কিছু সংস্কার ও পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব রয়েছে এবং এগুলো পরিবর্তন করা প্রয়োজন।”
‘৫১ জনকে হত্যার পরও একজন বেঁচে থাকার সুযোগ পাওয়ায় আমরা মনক্ষুণ্ন’
তিনি বলেন, “রিপোর্টে যেসব পরিবর্তনের বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে, মুসলিম সমাজ ও পুলিশের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।”
হামলায় নিহত একজনের বোন আয়া আল-উমারি বিবিসিকে বলেছেন, কমিশনের সুপারিশমালায় “সঠিক বিষয়গুলো” তুলে ধরা হয়েছে।
“প্রধানত: নিউজিল্যান্ডের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী কার্যক্রমকে আরো উন্নত করা, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স, সামাজিক সম্প্রীতি এবং জনগণের মধ্যে জাতিগত যে বৈচিত্র্য বাড়ছে সেসব বিবেচনা করে নিউজিল্যান্ড সরকারের পরিকল্পনা গ্রহণ করা,” বলেন মিস আল-উমারি।
তিনিও আরো বলেন, নিউজিল্যান্ডের অভিজ্ঞতা থেকে অন্যান্য দেশগুলোও শিক্ষা গ্রহণ করবে বলে তিনি আশা করেন। তবে এবিষয়ে প্রত্যেকেরই কিছু ভূমিকা আছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
“বিদ্বেষ-জনিত অপরাধ ও পক্ষপাতিত্ব কমাতে আমাদের প্রত্যেকের ভূমিকা আছে। একারণে আমরা গত বছরের ১৫ই মার্চের মতো ঘটনা ঘটতে দেখেছি।”
তবে নিউজিল্যান্ডের ইসলামি মহিলা পরিষদ এই রিপোর্টের সমালোচনা করে বলেছে যে এতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।
তারা বলছে, “অনেক বিষয়ে তদন্ত হয়নি এবং আমরা যেসব প্রশ্ন তুলেছিলাম সেগুলোও উপেক্ষা করা হয়েছে।”
“কমিশনাররা বলছে, এই ঘটনায় বেশ কিছু ব্যর্থতা ছিল আবার বলেছে যে এসব সত্ত্বেও সন্ত্রাসীকে আগে চিহ্নিত করা যেত না- আমাদের কাছে এটা উদ্বেগজনক।”
ব্রেন্টন টারান্ট একজন অস্ট্রেলিয় নাগরিক। তার নিজের সঞ্চয় এবং পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া প্রচুর সম্পদ দিয়েই সে জীবিকা নির্বাহ করতো। ২০১৭ সালে সে নিউজিল্যান্ডে চলে আসে।
তার কাছে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ছিল এবং নিউজিল্যান্ডে চলে আসার পর সে একের পর এক বন্দুক, শটগান এবং গোলাবারুদ কিনতে শুরু করে।
পরের বছরে ব্রেন্টন টারান্ট একজন ডাক্তারকে জানায় যে সে স্টেরয়েড নিচ্ছে এবং সপ্তাহে বেশ কয়েকবার টেস্টোসটেরনও গ্রহণ করছে। এবিষয়ে চিকিৎসক তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন কিন্তু এর পর তার কোন চিকিৎসা হয়নি।
এর পরের কয়েক বছর ধরে সে চরমপন্থীদের ওয়েবসাইটে যেত এবং তার ফেসবুক পাতায় মাঝে মধ্যেই উগ্রবাদী বিষয় পোস্ট করতো।
এমনকি বিভিন্ন সময়ে সে চরমপন্থী বিভিন্ন গ্রুপকেও অর্থ সহায়তা দিয়েছে।
ব্রেন্টন টারান্ট ২০১৮ সালে একবার এক আগ্নেয়াস্ত্র দুর্ঘটনায় আহত হয়। কিন্তু পুলিশের চোখে পড়ে যাওয়ার ভয়ে চিকিৎসা গ্রহণের ব্যাপারে তার মধ্যে উদ্বেগ ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সে হাসপাতালে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু সে যেরকম আহত হয়েছিল তাতে কারো মধ্যে কোন সন্দেহ তৈরি হয়নি।
হামলার আগে সে তার কিছু ডিজিটাল তথ্য প্রমাণ লুকাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা সেগুলো খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে ১৫ই মার্চে মসজিদে হামলার বিষয়ে তার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি।
পুলিশ কখনও এসব তথ্য প্রমাণ প্রকাশ করেনি।
অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ব্রেন্টন টারান্ট ১৫ই মার্চ আল নূর মসজিদের নামাজিদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় এবং তার এই হামলার ভিডিও সে সরাসরি ফেসবুকে প্রচার করে। তার মাথায় বেঁধে রাখা একটি ক্যামেরা দিয়ে এই হামলার ভিডিও লাইভ সম্প্রচার করা হয়েছিল।
এই মসজিদে হামলার পর সে গাড়ি চালিয়ে লিনউড ইসলামিক সেন্টারে গিয়ে বাইরের লোকজন এবং জানালা লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে।
সেন্টারের ভেতর থেকে একজন বের হয়ে এসে হামলাকারীর একটি শটগান কুড়িয়ে নিয়ে তাকে তাড়া করতে শুরু করে।
পরে পুলিশ তাকে তাড়া করে পাকড়াও করতে সক্ষম হয়।
গ্রেফতার হওয়ার পর ব্রেন্টন টারান্ট পুলিশকে বলেছে তার পরিকল্পনা ছিল হামলার পর দুটো মসজিদ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া।
এবছরের অগাস্ট মাসে তাকে যখন সাজা দেওয়া হয় তখন আদালতে বলা হয় যে আরো একটি মসজিদে হামলার পরিকল্পনা ছিল তার এবং তার আগেই তাকে আটক করা হয়।