নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক হাব (কেন্দ্রবিন্দু) রুপালি চত্বর। এই চত্বর দখলে ‘ভাবি-দেবরের’ দ্বন্দ্বে হাওয়া দিয়ে ফায়দা তুলতে মরিয়া তৃতীয় পক্ষ। আর ঘরের ভেতর-বাইরের চাপে ভাইয়ের পক্ষে দাঁড়াতে পারছেন না ভাই। স্বার্থের দ্বন্দ্বে পর হয়েছেন ভাগিনা-ভাতিজারা। গরিব হটিয়ে ধনাঢ্যরা জায়গা করে নিতে নোয়াখালীর রাজনীতি এখন দুভাগে বিভক্ত।
বিশেষ করে কোম্পানীগঞ্জে অপেক্ষাকৃত দুর্বল পক্ষের নেতৃত্বে আছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই ও বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। আর সামনে দাঁড়িয়ে আরেক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল। নেপথ্যে তাকে সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছেন নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। আর তাকে শেলটার দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও তার স্ত্রী-এমন অভিযোগ কাদের মির্জার।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্র চুপ থাকায় বারবার ঘটছে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ। ক্ষুণ্ন হচ্ছে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
তবে একরামুল করিম চৌধুরী বরাবরই বলেছেন, তিনি কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে নেই। তার বিরুদ্ধে কাদের মির্জা যেসব অভিযোগ তুলেছেন তার সবই মিথ্যা।
দলের হাইকমান্ডের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ১৩ মার্চ দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ওই সভায় নোয়াখালীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। নোয়াখালীর চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দৃষ্টি আছে।
এদিকে এ সংকটের অবসানের দাবিতে বসুরহাট পৌর ভবনের একটি কক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদী কর্মসূচি শুরু করেছেন আবদুল কাদের মির্জা। দাবি পূরণ না-হওয়া পর্যন্ত তিনি ঘরে ফিরবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তার সঙ্গে আছেন কয়েকশ নেতাকর্মী। তারা সেখানে আসছেন-যাচ্ছেন। দরকার হলে পরিস্থিতি তুলে ধরতে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সরকার দলের নেতা হয়েও সম্প্রতি নিজের পৌরসভা নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানের দাবি তুলে দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হন আবদুল কাদের মির্জা। একইসঙ্গে নিজের ভাই ওবায়দুল কাদের ও তার ঘনিষ্ঠ দুই সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী ও নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণসহ অপরাজনীতির অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হন তিনি।
এরপর থেকে নোয়াখালীর আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুভাগে ভাগ হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় দুপক্ষের পালটাপালটি কর্মসূচিতে উত্তপ্ত হয় রাজনীতির মাঠ। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক দফা মারামারি ও সংঘর্ষে দুজনের প্রাণ যায়। সবশেষ মঙ্গলবার বাদল গ্রুপ ও কাদের মির্জা গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলিতে একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আবদুল কাদের মির্জা বলেন, আমার কাছে অস্ত্র নেই। আমি অস্ত্রের রাজনীতি করি না। সব শক্তি এক হয়ে লেগেছে। অস্ত্রের শক্তি, টাকার শক্তি ও প্রশাসনের শক্তি। সঙ্গে মন্ত্রীর শক্তি যোগ হয়েছে। আমি এর শেষ দেখতে চাই।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, এতদিন আড়ালে-আবডালে ছোট ভাই আবদুল কাদের মির্জার ওপর বড় ভাই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কিছুটা সমর্থন থাকলেও এখন তা নেই। এর পেছনে ঘরেবাইরে মিলিয়ে প্রচণ্ড চাপ কাজ করেছে। পাশাপাশি নোয়াখালীর সব ধরনের কাজকর্মের একক নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে সংসদ সদস্য একরাম চৌধুরীর হাতে। সম্প্রতি এক ঘরোয়া সভায় ‘প্রধামন্ত্রীর কাছের একজনকে বলে দিয়েছি নোয়াখালী আমি চালাই’-এমন বক্তব্য দিয়ে একরামুল করিম সেটি প্রমাণও করেছেন। তাই দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ক্রমেই ভাগ্যবদলের আশায় কাদের মির্জার কাছ থেকে সরে একরামুল করিমের দিকে চলে যাচ্ছেন।
দুই গ্রুপের বলয়ের বাইরে থাকা স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না-করার শর্তে বলেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলকে মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন কাদের মির্জা ও তার ভাবি। শেষ পর্যন্ত বাদলকে মনোনয়ন না-দেওয়ায় ভাবি চূড়ান্তভাবে ক্ষিপ্ত হন। আর বাদল হন কাদের মির্জার শত্রুপক্ষ। এরপর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি খিজির হায়াত ও সাধারণ সম্পাদক নূরুন্নবীকে দল থেকে বহিষ্কার করেন আবদুল কাদের মির্জা। এই বহিষ্কাদেশ অবৈধ ঘোষণা করা হয় কেন্দ্র থেকে। এর পর থেকেই খিজির হায়াত ও নূরুন্নবী বাদলের গ্রুপে ভিড়েন। এভাবে একের পর এক কাদের মির্জার কাছের নেতা-কর্মীদের নিয়ে দল ভারী করেন বাদল। আর আড়াল থেকে সব ধরনের শেলটার দিয়ে স্থানীয় রাজনীতির হাব রুপালি চত্বর ও বসুরহাট পৌরসভায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনায় বাদলকে আবদুল কাদের মির্জার মুখোমুখি দাঁড়ি করিয়েছেন একরামুল করিম চৌধুরী। আর বাদল চর এলাকা থেকে সশস্ত্র লোকজন এনে পৌর চত্বর ও রুপালি চত্বরে বারবার পালটাপালটি কর্মসূচি দিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।
মঙ্গলবারের সংঘর্ষ প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান বাদল বলেন, ‘আমার মিটিং শুরু হওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সামনে কাদের মির্জার অস্ত্রধারীরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। তখন আমাদের লোকজন প্রতিরোধ শুরু করলে পুলিশ প্রশাসন বাধা দেয়। আমি হামলা করলে আমার কর্মী মারা যেত না। মির্জা কাদেরের লোকজন ছাদে দাঁড়িয়ে গুলি করেছে-এটা গোয়েন্দারাও দেখেছেন। সব সময়ই তিনি আমার লোকজনের ওপর হামলা চালিয়ে উলটো আমাকেই দায়ী করেন।’
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নীরব না থেকে আগেই ব্যবস্থা নিলে আজকের এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটত না। চুপ থাকায় এখন নিজেদের ঘরেই আগুন লেগেছে। এর ফল শুভকর হবে না। কারণ, একরামুল করিমের শেলটারে মিজানুর রহমান বাদলের দলই এখন ভারী। তার দলে আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা খিজির হায়াত খান, সাধারণ সম্পাদক নূরুন্নবী চৌধুরী, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, কাদের মির্জার ভাগিনা মাহবুবর রশীদ মঞ্জু, আরেক ভাগিনা স্বাধীনতা ব্যাংকার্স ফোরামের সদস্য ফকরুল ইসলাম রাহাত ও রিমন। এ ছাড়াও আছেন উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি নিজাম উদ্দিন মুন্না, সাধারণ সম্পাদক শাহ ফরহাদ, লিংকন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আজম পাশা চৌধুরী রুমেল, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আরজুমান পারভীন, সরকারি মুজিব কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি নূর-এ মওলা রাজু ও সাধারণ সম্পাদক রিয়াদ।
আর আবদুল কাদের মির্জার দলে আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইস্কান্দার হায়দার চৌধুরী বাবুল, সহসাধারণ সম্পাদক মো. ইউনুস, পৌর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়ের ও তার ছোট ভাই শাহাদাত হোসেন। এ ছাড়া পৌরসভার বেশিরভাগ ওয়ার্ড কাউন্সিলর তার অনুসারী। দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি স্থানীয় পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনও কাদের মির্জার হাতছাড়া হয়ে গেছে। তার কোনো কমান্ড এখন আর পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা মানেন না। আগে কাদের মির্জার নির্দেশে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা চলতেন। সেই প্রভাবে কাদের মির্জা অনেককেই হয়রানি করেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
নোয়াখালী সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সামীম কবির বলেন, পুলিশ কারও নির্দেশে কাজ করে না। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে।