বেসরকারি কলেজে শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষককে প্রেষণে পোস্টিং দেওয়ার কোনো বিধান না থাকলেও এক্ষেত্রে গুরুতর অনিয়ম করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অভিযোগ উঠেছে, প্রভাবশালী মহলের ক্ষমতার দাপটে এভাবে একজনকে লালমাটিয়া মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৯ বছর আগে সৌভাগ্যের এমন রক্ষাকবচ পেয়ে যান ড. রফিকুল ইসলাম। তিনি শিক্ষা ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচের একজন শিক্ষক। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ক্ষমতার ওই জাদুর কাঠির বলে তিনি একে একে নানা অঘটন ঘটিয়েছেন। অবাক হওয়ার বিষয় হলেও তিনি দুই জায়গা থেকে বেতন নিয়েছেন। ক্যাডার কর্মকর্তা হিসাবে তিনি সরকার নির্ধারিত কোড থেকে চেকের মাধ্যমে মূল বেতন ও টেলিফোন ভাতা তুলেছেন। অপরদিকে একই সময়ে প্রেষণে পোস্টিং পাওয়া বেসরকারি কলেজ থেকেও বেতনভাতা নিয়েছেন। এমনকি কলেজে অধ্যক্ষের জন্য নির্ধারিত বাড়িতে বসবাস করলেও কলেজ তহবিল থেকে বাড়িভাড়া নিতেও ভুল করেননি।
এখানেই শেষ নয়, কলেজে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ভাতা নেওয়ার নামে বিস্ময়কর বণ্টনের নজির পাওয়া গেছে। দেখা যায়, যে বিষয়ে তিনি অধ্যক্ষ হিসাবে ভাতা নিয়েছেন ৩ লাখ টাকা, সেখানে তারই সহকর্মী শিক্ষক পেয়েছেন মাত্র ৩শ টাকা। ক্ষোভে-দুঃখে ভারাক্রান্ত শিক্ষকদের অনেকে বলেছেন, এটা শিয়াল পণ্ডিতের সেই ভাগবণ্টনের গল্পকেও হার মানিয়েছে। তারা মনে করেন, এই মহিলা কলেজে পা দিয়েই তিনি যেন মৌচাকের বিশাল এক ভান্ডার পেয়ে যান। যে কারণে অবৈধ প্রেষণের মেয়াদ শেষ হলেও তিনি লিয়েন নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। পাঁচ বছরের জন্য লিয়েনও পেয়ে যান। একসময় লিয়েনের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু অবস্থা এমন যে, তাকে যে কোনো মূল্যে এই কলেজের অধ্যক্ষ থাকতেই হবে। অগত্যা কী আর করা। অসীম ক্ষমতার প্রভাববলয়ে গত বছর ফের তাকে প্রেষণে নিয়োগ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এই যখন অবস্থা, তখন গত ৯ বছরে তার সম্পদও বেড়েছে অস্বাভাবিক গতিতে। নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের খোঁজ মিলেছে অভিযুক্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। যুগান্তরের দীর্ঘ অনুন্ধানে এসব বিষয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ওদিকে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনও এই অধ্যক্ষের বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. গোলাম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি এভাবে পদায়ন করে, তাহলে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা বেসরকারি কলেজে কর্মরত থাকতে পারবেন। তবে সরকারি তহবিলের বেতনভাতা নেওয়ার পাশাপাশি একই সময়ে পদায়নকৃত অন্য কর্মস্থল থেকে বেতনভাতা নিতে পারবেন না।’
অবৈধ নিয়োগ : নথিপত্রে দেখা যায়, গত ৯ বছরে ড. রফিকুল ইসলামকে প্রেষণ ও লিয়েনে লালমাটিয়া কলেজের অধ্যক্ষ পদে পদায়নের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ৩টি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ২০১২ সালের ৯ জুলাই প্রথম প্রজ্ঞাপনে আর্থিক সুবিধা প্রদানের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, ‘তিনি (ড. রফিকুল ইসলাম) নিজ বেতনক্রম অনুযায়ী বেতনভাতা গ্রহণ করবেন। প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিনা ভাড়ায় বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হলে তিনি বাড়িভাড়া সুবিধা পাবেন না।’ এর মধ্যে ২০১২ সালের ৯ জুলাই থেকে ২০১৬ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রেষণ, ২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত লিয়েন, ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পুনরায় প্রেষণ প্রদান করা হয়। বিএসআর পার্ট-১-এর ৩৪ বিধি অনুযায়ী ‘নিজ সার্ভিসের বাইরে ৫ বছরের অধিককাল থাকলে তিনি সরকারি চাকুরে হিসেবে গণ্য হবেন না। এই চাকুরির সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার সম্পর্ক ছিন্ন হবে।’ লিয়েন বিধিমালা ২০২১-এর বিধি ১১-এর (ক) অনুযায়ী, ‘একাধারে অথবা বিচ্ছিন্নভাবে সর্বোচ্চ ৫ বছর লিয়েন সংরক্ষণ করা যাবে।’
বিধিবহির্ভূত বেতনভাতা উত্তোলন : জানা যায়, ড. রফিকুল ইসলাম শিক্ষা ক্যাডারের ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তা। ১৯৯২ সালে ১৩তম বিসিএস ব্যাচে প্রভাষক (হিসাববিজ্ঞান) হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন। শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষক হিসাবে মূল কর্মস্থল মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে বেতন পান মাসিক ৭৬ হাজার ৬৮৪ টাকা। পাশাপাশি কলেজ থেকেও মাসিক ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা বেতনভাতা নিচ্ছেন, যা বিধিবহির্ভূত এবং দুর্নীতি সমতুল্য।
শিক্ষা ক্যাডারের এই শিক্ষকের প্রেষণ নিয়োগপত্রের ৩নং শর্তে বলা হয়েছে, কলেজ বাসস্থানের ব্যবস্থা করলে তিনি বাসায় বসবাস করবেন, বাড়িভাড়া ভাতা পাবেন না। তিনি কলেজ ক্যাম্পাসে অধ্যক্ষের জন্য নির্ধারিত ডুপ্লেক্স বাড়িতে বসবাস করেন। অথচ রফিকুল ইসলাম মাসিক ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা বাড়িভাড়াসহ আবাসিক সুবিধা ভাতা গ্রহণ করছেন। একই কলেজ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য তিনি একাধিক হিসাবও খুলেছেন, যা উদ্দেশ্যমূলক। এমনটিই মনে করেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
২০১৬ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত লিয়েনকালীন আড়াই লাখ টাকা বেতনভাতা তুলছেন। এভাবে তিনি অভ্যন্তরীণ ফি বণ্টন নাম দিয়ে নিজের অ্যাকাউন্টে ভরেছেন বিপুল অঙ্কের টাকা।
দুই জায়গা থেকে বেতনভাতা নিতে পারেন কি না-জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপপ্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম চৌধুরী রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘দুই জায়গা থেকে বেতনভাতা পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার পর ড. রফিকুল ইসলামের সরকারি বেতন এ মাসে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রেষণ ও লিয়েনকালীন সরকারিভাবে টাকা নিয়ে থাকলে তার সব টাকা ফেরত দিতে হবে। ফেরত না দিলে পেনশন আটকে দেওয়া হবে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তথ্য গোপন করে একজন শিক্ষক এভাবে সুবিধা নেবেন, আমরা এটা আশা করি না।’
এদিকে এ বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ তালাশ করতে গিয়ে সত্যতা পাওয়া যায়। এ সংক্রান্ত নথিপত্রে দেখা গেছে, গত বছরের ৩ আগস্ট চেক নং সিএএল ১৯৩৬৮৮০-এর অনুকূলে আইএফআইসি ব্যাংকের হিসাবে (১০২৫৬৪০৮৬২৮১১) রফিকুল ইসলাম ওই বছরের জুলাই মাসের বেতন-ভাতা বাবদ আড়াই লাখ টাকা নেন। আবার একই বছরের ২৩ আগস্ট অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফি বণ্টনের নামে নিয়েছেন ১৭ লাখ ৯ হাজার ৩৩ টাকা ৫৫ পয়সা। তথ্যসূত্র বলছে, কলেজের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় আদায়কৃত ফি থেকেই বণ্টনের নামে গত ৯ বছরে তুলে নিয়েছেন পৌনে ৩ কোটি টাকা। এই টাকার আয়করও পরিশোধ করা হয়েছে কলেজ ফান্ড থেকে। যার পরিমাণ প্রায় কোটি টাকা। মূলত নিজ বেতনক্রমে প্রেষণে নিয়োগ নেওয়া এই শিক্ষক প্রতিষ্ঠানটিকে টাকা কামানোর মেশিনে রূপান্তরিত করেছেন। এমন মন্তব্য করেছেন কলেজটির অনেকে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়কৃত অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে ২০০৭ সালের একটি পরিপত্র সংশোধনের মাধ্যমে জারি করা হয়। ২০১৪ সালের ৬ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব (অডিট ও আইন অধিশাখা) রঞ্জিত কুমার সেন স্বাক্ষরিত ওই পরিপত্রের শেষ অংশে বলা হয়, ‘পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ প্রতি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা সম্মানি ভাতা গ্রহণ করতে পারবেন।’
এছাড়া অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুই জায়গা থেকে বেতনভাতা নেওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে। এ সংক্রান্ত নথিতে দেখা যায়, গত ১ জুলাই তিনি শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসাবে সরকারিভাবে ৭১ হাজার ২শ টাকা বেতন নিয়েছেন। একইভাবে পরবর্তী মাসগুলোয়ও বেতন নেওয়ার ধারাবাহিকতা আছে তথ্যানুসন্ধানে পাওয়া নথিতে। আবার ১০ আগস্ট এই অধ্যক্ষ বাসা ভাড়াসহ সব সুবিধার খরচ হিসাবে একই ব্যাংকের ১০২৫৬৪০৮৬২০২১ হিসাবে দেড় লাখ টাকা নেন লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে। অপরদিকে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফি বণ্টনের নামে নিয়েছেন ৯ লাখ ১৮ হাজার ৯৫ টাকা ৭৮ পয়সা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে লালমাটিয়া কলেজের একজন প্রভাষক যুগান্তরকে বলেন, ‘গত ৯ বছরে রফিকুল ইসলামের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তদন্ত করলেই অধ্যক্ষ হিসাবে তিনি কত টাকা নিয়েছেন, এর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে। নিশ্চয় দুদক যখন তদন্ত শুরু করবে, ব্যাংক হিসাবের বিষয়টি আমলে নেওয়া হবে।’
তথ্যানুসন্ধানে কলেজের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার অসম বণ্টনের চিত্রও পাওয়া যায়। এ সংক্রান্ত নথিপত্রে দেখা যায়, কলেজের দর্শন বিষয়ের শিক্ষক বদরুম মুনিরা খানম অনার্স তৃতীয় বর্ষের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফি বণ্টনের নামে গত বছর ২৩ আগস্ট সম্মানি পেয়েছেন ৩৪৬ টাকা ২২ পয়সা। অপরদিকে অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম নিয়েছেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৫১৭ টাকা ৫০ পয়সা। এভাবে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রেখে অসম বণ্টন করা হয়েছে। এভাবে অর্জিত বিপুল অঙ্কের টাকা তিনি তার আয়কর নথিতে বৈধ আয় বলে জায়েজ করার অপচেষ্টাও করেন।
নথিপত্র বলছে, ২০২০-২০২১ আয়কর বর্ষে ৯২ লাখ ২ হাজার ৩৫১ টাকা আয় করার তথ্য দেন রফিকুল ইসলাম। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা তার কৃষি আয় আছে। এই আয়করের ১৬ লাখ ৬১ হাজার ৭৫৪ টাকার মধ্যে ১১ লাখ ৭৪ হাজার ৪৮০ টাকা কলেজ ফান্ড থেকে পরিশোধ করেছেন তিনি। এই করবর্ষে বার্ষিক ৫২ লাখ ৩৫ হাজার ৮৬৮ টাকা নিয়েছেন বেতন হিসাবে। আর অভ্যন্তরীণ বণ্টন (শিক্ষার্থীদের থেকে পরীক্ষার ফি বাবদ আদায়কৃত অর্থ) বাবদ নিয়েছেন ১৭ লাখ ৯ হাজার ৩৩ টাকা। বহিঃপরীক্ষার বণ্টন বাবদ নিয়েছেন ১৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বৈশাখী ভাতা নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা।
এদিকে ২০২১-২২ করবর্ষে কলেজ থেকে বেতন নিয়েছেন ৪২ লাখ ৯ হাজার ৭৬৯ টাকা এবং আয়কর বাবদ নিয়েছেন ৮ লাখ ৮৬ হাজার ২৮১ টাকা। অভ্যন্তরীণ বণ্টনের নামে নিয়েছেন ৯ লাখ ১৮ হাজার ৯৫ টাকা। বহিঃপরীক্ষা বাবদ নিয়েছেন ১৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ২০২১ সালে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে কলেজ ফান্ড থেকে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। অথচ শিক্ষক কল্যাণ তহবিলে তিনি ৯ বছরে এক টাকাও জমা দেননি।
অস্বাভাবিক সম্পদ : ২০২০ সালে আয়কর নথির নগদ তহবিল বিবরণীতে ১ কোটি ২১ লাখ ৪০ হাজার ৪৬৪ টাকা নগদ প্রাপ্তি দেখিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। একই অর্থবছরে বিনিয়োগকে ব্যয় হিসাবে দেখিয়েছেন ৯২ লাখ ৮০ হাজার ৩৫০ টাকা। এর মধ্যে এক বছরেই সঞ্চয়পত্র ক্রয় ১৫ লাখ টাকা, ভবিষ্যতহবিলে চাঁদা (জিপিএফ) ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, একটি প্রাইভেট ব্যাংকে তার পৃথক ২টি এফডিআর ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা, মেয়ের নামে এফডিআর ১২ লাখ টাকা। কলেজ ক্যাম্পাসের বাসায় থাকলেও পারিবারিক খরচ ৩৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯শ টাকা দেখানো হয়।
একই অর্থবছরে রাজধানীর ইন্দিরা রোডের পশ্চিম রাজা বাজারের ৪৭/৫ চৌধুরী ভিলার ৭/এ নম্বর ফ্ল্যাটটি ১ কোটি ৩৯ লাখ ৮৬ হাজার ৬৮০ টাকা দাম দেখিয়ে স্ত্রীকে দান করেন। এ রকম কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তিনি নিজের নামে ঢাকায় কোনো ফ্ল্যাট নেই বলে প্রমাণ করেন। এমন তথ্য তুলে ধরে তিনি লালমাটিয়ায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের একটি ফ্ল্যাট নিয়েছেন। যার তিনটি কিস্তিতে ৩২ লাখ ৮৪ হাজার ৬০০ টাকা পরিশোধ করেছেন। এর মধ্যে ২০২০ সালে পরিশোধ করেন ১১ লাখ ৬০ হাজার ৩৫০ টাকা। প্রসঙ্গত, নিজের নামে ফ্ল্যাট কিংবা প্লট থাকলে তার নামে সরকারি কোনো ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নেই।
এখনেই শেষ নয়। এরপর তিনি চলতি অর্থবছরে নিজের নামে কেনেন সাফা গ্রিন সিটির ব্যয়কন লি. এর প্লট। আয়কর নথি অনুযায়ী প্লট কেনার প্রথম কিস্তি হিসাবে তিনি পরিশোধ করেন ১১ লাখ টাকা।
২০২১ সালে এই অধ্যক্ষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আসা টাকা (নগদ প্রাপ্তি) দেখানো হয়েছে, ১ কোটি ২০ লাখ ২২ হাজার ৭১৪ টাকা। এই অর্থবছরেও বিনিয়োগকে ব্যয় হিসাবে দেখিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। সেখানে দেখা যায়, যে দুটি এফডিআরের কিস্তি ছিল ৩ লাখ ৬০ হাজার, তা বৃদ্ধি করে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা করেছেন। এই অর্থবছরে নতুন করে নিজের নামে তিন মাস মেয়াদি আরও একটি এফডিআর করেছেন। যার কিস্তি দিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। মেয়ের নামে নতুন আরেকটি এফডিআরে একটি কিস্তিই দিয়েছেন ২০ লাখ টাকা। সাফা গ্রিন সিটির ব্যয়কন লিমিটেডের প্লটের কিস্তিও দিয়েছেন ৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। চলতি বছরের উৎসকর, বিগত বছরের কর, বকেয়া করকে বর্তমান বছরের খরচ হিসাবে দেখিয়েছেন ৪১ লাখ ১৯ হাজার ৯ টাকা। পূর্ববর্তী বছরে তার ঋণের পরিমাণ ৪১ লাখ টাকা দেখিয়ে পরিশোধ করা হয় ১৫ লাখ টাকা। ঋণদাতা ব্যক্তির নাম জনৈক এম এ জলিল।
নথিপত্রে দেখা যায়, সাভারের বরদেশী মৌজায় নিজের নামে ৭ শতাংশ জমি ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও মেয়ের নামে ৫ শতাংশ জমি ৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকায় কিনেছেন। উদয়াচল বহুমুখী সমবায় সমিতির প্লট ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, সাফা গ্রিন সিটির প্লট ২২ লাখ ৪৪ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। ভবিষ্যতহবিলে (জিপিএফ) টাকা জমা দেওয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম করেছেন রফিকুল ইসলাম। কারণ সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে যে বেতন পেয়ে যাচ্ছেন তার ২৫ ভাগ জিপিএফ ফান্ডে জমা দিতে পারেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। কিন্তু এই অধ্যক্ষ জিপিএফ-এর টাকা জমা দিয়েছেন আড়াই লাখ টাকা বেতন হিসাবে। এতে সরকারের ক্ষতি হয়েছে লাখ লাখ টাকা। কারণ তিনি যে টাকা এই ফান্ডে জমা দিয়েছেন তার দ্বিগুণ টাকা সরকারকে পরিশোধ করতে হবে। সবশেষ সম্পদবিবরণীতে জিপি ফান্ডে ৬৯ লাখ ৭০ হাজার ৯৫৬ টাকা জমা দেখিয়েছেন তিনি। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ২৩ লাখ টাকা টাকা, মেয়ের নামে এফডিআর ৩২ লাখ টাকা, পেনশন সেভিং স্কিমে ১০ লাখ টাকা, স্ত্রীকে প্রদত্ত ধার ৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা, মৎস্য খামারে বিনিয়োগ ১১ লাখ টাকা। জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন ১৫ লাখ টাকা।
তথ্যানুসন্ধানে পাওয়া নথিপত্রে দেখা গেছে, রফিকুল ইসলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে বেতনভাতা বাবদ মাসিক যে ৭৬ হাজার ৬৮৪ টাকা নেন, এর মধ্যে ৭১ হাজার ২শ টাকা মূল বেতন, ৫শ টাকা নেন তার মেয়ের শিক্ষা ভাতা, ১ হাজার ৫শ টাকা নেন চিকিৎসা ভাতা, ১ হাজার টাকা নেন মোবাইল ভাতা এবং ২ হাজার ৪৮৪ টাকা নেন আবাসিক টেলিফোন ভাতা হিসাবে। ১০ হাজার টাকা জমা দেন তার নিজের ভবিষ্যতহবিলে। অথচ প্রেষণে থাকা কোনো কর্মকর্তা সরকারি তহবিল থেকে মোবাইল ভাতা, আবাসিক টেলিফোন ভাতা নেওয়ার বিধান নেই। এভাবেই সরকারি কলেজ শিক্ষক হয়েও তিনি নিজ সার্ভিসের বাইরে থেকে অবৈধভাবে এই আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন।
অধ্যক্ষের বক্তব্য : দুই জায়গা থেকে বেতন নিচ্ছেন কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘১৪ মাস সরকারি বেতন নিয়েছি। তবে ওই সময় লালমাটিয়া কলেজ থেকে কোনো টাকা গ্রহণ করিনি।’ বিধিবিধান লঙ্ঘন করে অসম বণ্টনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফি’র লাখ লাখ টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পরীক্ষার ফি’র ১০ ভাগ অধ্যক্ষ নিতে পারে, বাকি ৯০ ভাগ পান অন্য শিক্ষক কর্মচারীরা।’
সার্ভিস রুলস অনুযায়ী নিজ সার্ভিসের বাইরে ৯ বছর থাকতে পারেন কি না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি তো ইচ্ছা করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসিনি। মন্ত্রণালয়ের আদেশ বাস্তবায়ন করেছি।’ বিপুল অঙ্কের টাকা বেতনভাতা কলেজ থেকে নেওয়ার পরও আয়করের টাকা কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে এই অধ্যক্ষ বলেন, ‘পদায়নের চুক্তিতে আয়করের টাকা পরিশোধের বিষয়ে উল্লেখ আছে।’ বিপুল সম্পদ অর্জনের বিষয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রতিবছর আয়কর নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।’