কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত রোহিঙ্গা নেতা মহিব উল্লাহর দাফন গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বিকেলে আসরের নামাজের পর হাজার হাজার শোকার্ত রোহিঙ্গা মহিব উল্লাহর জানাজায় অংশ নেয়। এর আগে গতকাল কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে তাঁর মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। হত্যার বিষয়ে মহিব উল্লাহর পরিবার উখিয়া থানায় একটি মামলা করেছে। মহিব উল্লাহর ছোট ভাই অভিযোগ করেছেন, এই হত্যাকাণ্ডে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) জড়িত।
‘আমার ভাইকে আরসা হত্যা করেছে’ : মহিব উল্লাহর ছোট ভাই হাবিব উল্লাহ গতকাল সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেছেন, ‘আমার ভাইকে আরসার সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে। হত্যাকারীদের সবার হাতেই ছিল বিদেশি পিস্তল।’ তিনি আরো বলেন, এর আগেও তাঁর ভাইকে অনেকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ : কুতুপালং ১ নম্বর শিবিরের লম্বাশিয়া এলাকার আরসা জিম্মাদার মাস্টার আবদুর রহিম, জিম্মাদার ছমিউদ্দিন, শফি আলম, মোহাম্মদ রশিদ, খাইরুল আমিন, আবদুস সালামসহ আরো কয়েকজন মহিব উল্লাহ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মহিব উল্লাহর প্রতিবেশী আরসা সদস্য মোস্তফার ঘরে ঘাতক সদস্যরা ওত পেতে ছিলেন বলে জানা গেছে।
ভয়ে মুখ খুলতে রাজি নয় রোহিঙ্গারা : রোহিঙ্গা নেতা মহিব উল্লাহকে হত্যা করা হবে—এটা কারো ভাবনায় ছিল না। রোহিঙ্গা শিবিরে তাঁর বেশ গ্রহণযোগ্যতা ছিল। অসাধারণ সম্মোহনী শক্তির কারণে সাধারণ রোঙ্গািদের কাছে তিনি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এমন নেতাকে হত্যা করার পর থেকেই রোহিঙ্গা শিবিরের সাধারণ রোহিঙ্গারা রীতিমতো হতবাক হয়ে পড়েছে। মহিব উল্লাহকে হত্যার পর থেকে রোহিঙ্গারা এমনই ভীতিকর অবস্থায় রয়েছে যে এ সম্পর্কে কেউ মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছে না। এমনকি আরসাবিরোধী অনেক রোহিঙ্গা নেতা নিরাপত্তার অভাবে শিবির ছেড়ে অন্যত্র গাঢাকা দিতেও শুরু করেছে।
মৃত্যুর আগে শেষ কথা : ‘আমাদের মনে হয় আর বেশিদিন এখানে থাকতে হবে না। আমরা আমাদের দেশে ফিরতে পারব’—গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে সন্ত্রাসীদের হামলার আগে এই ছিল মহিব উল্লাহর শেষ কথা। এর পরপরই ‘পুলিশ আইয়্যের, পুলিশ আইয়্যের’ চিৎকারে হুড়াহুড়ি পড়ে যায়। পুলিশের ভয় দেখিয়ে মহিব উল্লাহর সঙ্গে তাঁর সংগঠনের কার্যালয়ে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সরিয়ে দিতেই এমন কৌশল নিয়েছিল সন্ত্রাসীরা। এর পরই আততায়ীরা খুব কাছ থেকেই মহিব উল্লাহকে পিস্তল দিয়ে গুলি করে। একে একে পাঁচটি গুলি ছুড়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেই তারা গাঢাকা দেয়।
মহিব উল্লাহ আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) নামের সংগঠনের চেয়ারম্যান। মহিব উল্লাহর সঙ্গে থাকা রোহিঙ্গা নুরুল আমিন হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘এশার নামাজের পর আমরা সবাই অফিসে গিয়ে বসি। মহিব উল্লাহ আমাদের নিয়ে বসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলাপের কথা বলেন। তিনি শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে দেশে ফেরানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলাপের কথাও বৈঠকে প্রকাশ করেন।’
নুরুল আমিন বলেন, মহিব উল্লাহ এমনই একজন খাঁটি রোহিঙ্গা নেতা, যিনি মৃত্যুর আগমুহূর্তেও রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে নিরাপদ জীবনযাপনের কথাই চিন্তা করেছেন।
এমন জনপ্রিয় যেভাবে : সাধারণ রোহিঙ্গা পরিবারের সন্তান মহিব উল্লাহ। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের (আরাকান) মংডুর গারাতিবল এলাকার মৌলভি ফজল আহমদের ছেলে তিনি। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে রোহিঙ্গা ঢলের সময় মহিব উল্লাহ যখন বাংলাদেশে আসেন তখন নেতৃত্বহীনতায় ভুগছিল রোহিঙ্গারা। এর আগে যত রোহিঙ্গা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে বিদেশি দাতাদের টাকা নিয়ে নিজের ভাগ্য গড়ার অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহিব উল্লাহ রাখাইনে নিজের এলাকায় শিক্ষকতা করেছেন। পরে সেখানে একটি এনজিওতে বেশ কয়েক বছর চাকরিও করেছেন। কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে এসে তিনি জাতিগত সমস্যার বিষয়টি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরা শুরু করেন। ইংরেজি ও বার্মিজ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট ‘জেনোসাইড দিবস’ পালন উপলক্ষে কুতুপালং শিবিরে তাঁর ডাকে পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার সমাবেশ হওয়ার পর থেকে মহিব উল্লাহ বিশেষভাবে আলোচিত হন। ওই বছরই এর আগে তিনি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে সাক্ষাৎ করেন।
এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের তরফে যখন রোহিঙ্গাদের কার্যত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে একীভূত করার প্রস্তাব দেওয়া হয় তখন মহিব উল্লাহ এর বিরোধিতা করেন।
কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাধারণ রোহিঙ্গাদের দাবি, আরসা এর আগেও মহিব উল্লাহকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। বুধবার রাতে আরসার ওই শীর্ষ নেতা সরাসরি মহিব উল্লাহর হত্যার মিশন পরিচালনা করেন।